১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখের ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি কলামে হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে কি না সে বিষয়ে প্রখ্যাত নিসর্গবিদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া প্রশ্ন রেখেছেন।
প্রবন্ধটি ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনপূর্বক সম্পূর্ণ তুলে ধরলাম।
প্রাণী : হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে
বিপ্রদাশ বড়ুয়া
হাতি অচিরে, অদূর ভবিষ্যতে লুপ্ত হয়ে যাবে। বুনো হাতি তার আবাস বন ছেড়ে ঘন ঘন লোকালয়ে নেমে আসায় এই অর্থই প্রকাশ করে। এর প্রধান কারণ এদের আবাস বা হ্যাবিট্যাট-এর ক্রমাবনতি। আমাদের দেশে হাতিদের প্রধান বিপদ আসছে তাদের আবাসস্থলের সঙ্কোচন ও অবস্থার ক্রমাবনতির জন্য। চোরাগোপ্তা হাতি শিকারিদের আক্রমণ থাকলেও তার জন্য নয়।
নাগা, কুকি, মিজো ও আরও কিছু আদিবাসীরা হাতির মাংস খুব পছন্দ করে। এজন্য মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও তাদের সংলগ্ন অঞ্চলে হাতি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
ইত্তেফাক পত্রিকার কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অফিস থেকে ২৮ ও ২৯ আগস্ট পর পর দু’দিন কক্সবাজারের নাইক্ষংছড়ি ও চট্টগ্রামের বাঁশখালি, বোয়ালখালি, রাঙ্গুনীয়া, লোহাগড়া প্রভৃতি এলাকায় গত পাঁচ বছরে হাতির উৎপাতের খতিয়ান দিয়েছে। তাদের মতে, এই সময়ের মধ্যে বুনো হাতির আক্রমণে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। আহত হয়েছে তার চেয়েও বেশি।
প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতি যূথবদ্ধ হয়ে বিচরণ করছে। ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, আরাকান-বার্মাসহ এই অঞ্চল বুনো হাতির প্রাকৃতিক আবাস। আরাকান-বার্মার সাদা হাতিও এখানে থাকত। তখন শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২০০ হাতি ছিল। আবার এরা দেশান্তরীও হত। খেদা দিয়ে এসব হাতি ধরে শিক্ষা দিয়ে পোষ মানানো হত। চট্টগ্রাম জেলা কর্তৃপক্ষ খেদা দেয়ার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করত। প্রতিটি হাতির জন্য তাদের ৭৫০ টাকা সরকারকে দিতে হত। খেদার কাজে ১০০ থেকে ১৫০ লোক নিয়োজিত হত। খেদায় পড়া হাতিদের ২৪ ঘণ্টা খাবার ও পানি দেয়া হত না। তারা তখন শক্ত খুঁটির ঘেরার ফাঁক দিয়ে নাক বের করে একে একে সাহায্য চাইত। সেখানে শিক্ষিত হাতি নিয়ে থাকত মাহুতেরা। আস্তে তারা বুনোদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসত।
১৯৮৫ সালে ভারতে ১৭ থেকে ২১ হাজার হাতি ছিল। সেখানে এখন আছে হয়তো অর্ধেকের কম। বাংলাদেশে ৩০০ হাতি আছে বলে ধরা হয়। আর আকবরের সময় ছিল ৩২ হাজার। জাহাঙ্গীরের সময় এক লাখ ত্রিশ হাজার। আর আমাদের ৩০০ হাতি অচিরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন ৫০টি হাতি সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে। এরপর হাতি চলে যাবে চিড়িয়াখানায়। পৃথিবীর বহু দেশে যেমন শুধু চিড়িয়াখানাতেই রয়েছে। তারপর থাকবে শুধু বইপত্রে যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট-ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক সময় গন্ডার ছিল।
শেরপুর, নেত্রকোনার উত্তরে ভারতের মেঘালয় থেকে হাতি এসে উৎপাত করে। সেখানে তিন হাজারের মতো হাতি আছে বলে মনে করা হয়, আর আমাদের সারাদেশে আছে মাত্র তিনশো। মেঘালয়ে বালফাক্রাম জাতীয় উদ্যান করা হয়েছে দুশো বর্গ কিমি জমি নিয়ে। সেখানে শুকনো মরসুমে এক হাজার পর্যন্ত হাতি জড়ো হয়। বর্ষা নামলেই হাতি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় হাতির প্রজননকাল।
এখন হাতি এসে কক্সবাজার থেকে রাঙ্গুনীয়া পর্যন্ত উৎপাত করছে। নেত্রকোনা শেরপুর অঞ্চলেও করছে। হাতিদের প্রধান দাবি দিনদুনিয়ার মালিক বলে দাবিদার মানুষের কাছে, আমাদের কথা একটু ভাবুন, আমাদের অরণ্য দাও থাকা ও খাওয়ার জন্য। আর আমাদের থাকার জায়গায় যদি আপনারা ঘর ও চাষবাস করেন তাহলে আমাদেরই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে বৈকি! কারণ আমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। এই পৃথিবীর উপর সকল জীবজন্তু, পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ, সাপ ও মাছ সবার হক আছে। সে জন্য যদি আমরা পথ ভুলে বোয়ালখালি থানা থেকে কর্ণফুলী পার হয়ে কালুরঘাট চলে এসে আস্তানা খুঁজি? বলা তো যায় না, মাস্টারদা সূর্য সেনের জালালাবাদ পাহাড়ে বসত খুঁজি? বাটালি পাহাড়, টাইগার পাস, দিয়াং পাহাড়ে চলে আসি? ওসব এলাকায় এক সময় আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন। এতই যদি আঁতকে ওঠেন তবে মাথা ঠাণ্ডা করে আমাদের কাপ্তাই, ওয়াগ্গা, সীতা পাহাড় ছেড়ে দিন। আমাদের অবাধে চলার অভয়ারণ্য দিন। আপনারা বাড়তে বাড়তে ১৫ কোটি হয়েছেন, আমরা কমতে কমতে ৩০০ হবো কেন? জ্ঞানী-গুণী বলে পরিচিত আপনারা, আর একটু ভাবুন আমাদের হাতি জাতির কথা। পার্বত্য চট্টগ্রামে লাখ লাখ মানুষ এনে গুঁজে দিচ্ছেন, পাহাড়-অরণ্য শেষ করে দিচ্ছে তারা, কর্ণফুলীতে বাঁধ দিয়ে ঘন ঘাসের বন ডুবিয়ে দিয়েছেন, পাহাড়ী মানুষ ও পাহাড়ী জীবজন্তুর কথা একবার কি ভেবে দেখেছেন? কোনো প্রকল্প নিয়েছেন লুপ্ত হয়ে যাওয়া এখানকার বাঘ, চিতাবাঘ, গন্ডার, সম্বার, নীলগাই, উড়ন্ত কাঠবিড়ালী, হনুমান, ময়ূর, রামকুত্তা, গৌর, চিত্রা-হরিণ, মায়া হরিণ, বাদি হাঁস, বনমোরগের কথা? শুনছি সুন্দরবনে বাঘ নাকি আছে ৩০০ মাত্র।
আমরা হাতিরা যদি না থাকি, অরণ্য যদি না থাকে, হে মানুষ! উৎসবে ও আনন্দে, কল্পনায় ও স্বপ্নে, মধুচন্দ্রিমা এবং অনিবার্য সন্তানদের নিয়ে তখন কার কাছে যাবেন? বলুন! বলো মানুষ, তোমরা আসলে কী চাও?
[লেখক: কথাসাহিত্যিক ও নিসর্গী]