কয়েকদিন আগের প্রথম আলো পত্রিকায় নিম্নোক্ত খবরটি পেলাম। ভয়ানক একটি ঘটনা পত্রিকা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করে ফেলেছেন। আমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে দেশ, জাতি তথা প্রকৃতির কতই না ক্ষতি করে চলেছি। খবরটি পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, সত্যিই আমরা কতই না বোকা!
নষ্ট হচ্ছে মাটি, মারা যাচ্ছে পাখি ও উপকারী কীট-পতঙ্গ
সাজ্জাদ হোসেন
নির্বিচারে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্ন। খোদ ২০০২ সালে ঘোষিত সরকারের সমন্বিত বালাই-ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিমালাতেও রাসায়নিক বালাইনাশকের ভয়াবহ ক্ষতির কথা স্বীকার করা হয়। নীতিমালার শুরুতেই বলা হয়, ‘অতীতে কৃষিক্ষেত্রে বালাই নিয়ন্ত্রণের জন্য বালাইনাশককে মহৌষধ হিসেবে গণ্য করা হতো। যদিও বালাইনাশক ব্যবহারে বালাই থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পাওয়া যায়, কিন্তু বর্তমানে এ ধারণাই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য যে, বালাইনাশকের বাছবিচারহীন ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর ওপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতা কৃষি উৎপাদনের ভিত নষ্ট করে দেয়। রাসায়নিক বালাইনাশকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা শুধু ব্যয়বহুলই নয়, পরিবেশের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসায়নিক বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার এ দেশের কৃষি খাতে খরচ বা বালাইনাশক ব্যবহারকারী কৃষকের শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে না, এর প্রভাবে জমি হারাচ্ছে তার উর্বরাশক্তি, বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির মাছ, হারিয়ে যাচ্ছে কৃষির জন্য উপকারী অনেক কীটপতঙ্গ, পাখি। শুধু বালাইনাশক নয়, রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহারও একইভাবে ক্ষতি করছে গোটা প্রতিবেশের।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি হওয়ার একটি বড় কারণ বালাইনাশকের সহজলভ্যতা।
বাড়ছে অম্লত্ব, কমছে উর্বরাশক্তি: বাংলাদেশ মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন মো. শোয়েব প্রথম আলোকে বলেন, মাটি একটি জীবন্ত জটিল বস্তু। মাটির উপরিভাগের চার থেকে ছয় ইঞ্চি পুরু স্তরটি এক মহামূল্যবান সম্পদ। কেবল এই স্তরটিই গাছের খাদ্য উপাদানের জোগান দিয়ে থাকে। এক চা-চামচ পরিমাণ আদর্শ মাটিতে ৪০০ কোটির বেশি অণুুজীব থাকে। কিন্তু কোনো কারণে যদি মাটিতে থাকা অণুজীবগুলো মারা যায় বা অনুকুল পরিবেশে থাকতে না পারে, তাহলে মাটি থেকে গাছের খাদ্য গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে ব্যাহত হয় ফসলের উৎপাদন। কেননা এই অণুজীবগুলোই মাটিতে থাকা খাদ্য উপাদানগুলোকে গাছের গ্রহণোপযোগী করে।
বালাইনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে কৃষিজমির কতটা ক্ষতি হচ্ছে? জবাবে মো. শোয়েব বলেন, কৃষি-রাসায়নিক বা অ্যাগ্রো-কেমিক্যাল (রাসায়নিক বালাইনাশক, রাসায়নিক সার ইত্যাদি) ব্যবহারের ফলে মাটির ভেতরের অণুজীবগুলো তাদের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে মাটির উর্বরাশক্তি কমে যায়। ভেঙে যায় মাটির বুনট। শক্ত হয়ে পড়ে মাটি। মাটির পরিমিত পানি ও বাতাস ধারণক্ষমতা কমে যায়। বেড়ে যায় অম্লত্ব। আর অম্লত্ব বেড়ে গেলে মাটি থেকে গাছের খাদ্য-উপাদান গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়।
মো. শোয়েব বলেন, ১০ বছর ধরে দেশের ৪০টি নির্ধারিত এলাকা থেকে ‘মাটির উর্বরতা পরিবীক্ষণ কর্মসুচির’ অধীনে মাটির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের মাটি অম্লধর্মী হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অসম হারে যত বেশি কৃষি-রাসায়নিক ব্যবহার করা হবে, মাটির স্বাস্েথ্যর ততই অবনতি হবে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মাটি একসময় পুরোপুরি অনুর্বর হয়ে যেতে পারে। মো. শোয়েব বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই ফসল উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু তা কোনোভাবেই প্রতিবেশের ক্ষতি করে নয়।’
দুষিত হচ্ছে মাছের আবাসস্থল, উৎপাদন কমছে মাছের: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জাহের প্রথম আলোকে বলেন, রাসায়নিক কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে মিঠাপানির অনেক ছোট মাছের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে মাছেরা ডিম পাড়ে। দেশীয় প্রজাতির মাগুর, শিং, কই, টাকি, পুঁটি, টেংরা, পাবদা, মেনি প্রভৃতি প্রজাতির ছোট মাছ অগভীর জলাশয়, বিল, হাওরে ডিম পাড়ে। আর অগভীর এসব জলাশয়ে আগাম আমন, নাবি বোরো জাতের ধান চাষ ওই সময়টাতে হয়ে থাকে।
মো. জাহের বলেন, ‘ক্ষেতে পোকা দেখলেই বেশির ভাগ কৃষক কীটনাশক ছিটাতে শুরু করে। ছিটানো কীটনাশক যখন ধানগাছের নিচে থাকা পানিতে মেশে, তখন তা মাছের ফুলকা, যকৃৎ, বৃਆের (কিডনি) ক্ষতি করে। মাছের স্মায়ুতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাছ স্বাভাবিক মাত্রায় ডিম দিতে পারে না। ডিম থেকে রেণু উৎপাদনের হার কমে যায়। পোনা বাঁচার হার কমে যায়।’
মারা যাচ্ছে উপকারী পোকা: ফসলের জন্য অনিষ্টকারী পোকা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে উপকারী পোকা। উপকারী পোকারা অনিষ্টকারী পোকাদের দমনে অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা পালন করে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সমন্বিত বালাই-ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের প্রধান পর্যবেক্ষক ড. সৈয়দ নুরুল আলম বলেন, ‘গবেষণা ও জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, আমাদের দেশে ধানক্ষেতে ক্ষতিকর পোকার চেয়ে উপকারী পোকা থাকে চার গুণ বেশি। অর্থাৎ শতকরা ১৭ থেকে ২০ ভাগ ক্ষতিকর পোকার বিপরীতে ৮০ থেকে ৮৩ ভাগ উপকারী পোকা বিচরণ করে। একইভাবে সবজিতে শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষতিকর পোকার বিপরীতে সাধারণত ৭০ ভাগ উপকারী পোকা মাঠে ঘোরাফেরা করে।’
কিন্তু রাসায়নিক কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকারী পোকারা। এ তথ্য কীটতত্ত্ববিদ ও কৃষি বিভাগের মাঠ-কর্মকর্তাদের।
এ প্রসঙ্গে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শরীফ মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করলে সবার আগে উপকারী পোকারা মারা পড়ে। কারণ উপকারী পোকারা সাধারণত ওপরের দিকে বিচরণ করে। তাদের ভয়ে ক্ষতিকর পোকারা গাছের নিচের দিকে আশ্রয় নেয়। আমাদের দেশে শতকরা ৯০ ভাগ বালাইনাশক ওপর থেকে ছিটানো হয়। ফলে প্রথমেই ওপরে থাকা উপকারী পোকারা মারা যায়।’ তিনি বলেন, যখন ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানো হয়, তখন নিচের দিকে থাকা ক্ষতিকর পোকারা ফসলের ক্ষেত থেকে সরে গিয়ে পাশের আলে ঘাসের ভেতর আশ্রয় নেয়। কীটনাশকের প্রভাব কমে গেলে এবং তাদের শত্রু ‘উপকারী পোকারা’ মারা গেলে অনিষ্টকারী পোকারা আরও বেশি মাত্রায় ফসলের ক্ষতি করে। তখন ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
কীটনাশকের সহজলভ্যতা আত্মহত্যা সংগঠনের বড় কারণ: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি হওয়ার একটি বড় কারণ বালাইনাশকের সহজলভ্যতা। গ্রামাঞ্চলে যত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে, তার ৯০ শতাংশের বেশি ঘটছে বিষপানজনিত কারণে। আর এসব ঘটছে দরিদ্র অথবা সচ্ছল কৃষক-পরিবারে।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি ঝিনাইদহে। ঝিনাইদহ জেলা সিভিল সার্জন অফিসের সুত্রমতে, এই জেলায় গত পাঁচ বছরে (২০০৩ থেকে ২০০৭) মোট ৭৮৩ জন আত্মহত্যা করে। এদের ৭৫১ জনের মৃত্যু হয় কীটনাশক পানে। অর্থাৎ প্রায় ৯৬ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে কীটনাশক পানে।
সিভিল সার্জন নিরঞ্জন সরকার বলেন, ‘কীটনাশকের সহজলভ্যতা আত্মহত্যা সংগঠনের একটি বড় কারণ। কৃষকের ঘরে কীটনাশক এখন অত্যন্ত মামুলি বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
ঝিনাইদহে আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সোসাইটি ফর ভলানটারি অ্যাকটিভিটি (শোভা)। শোভার নির্বাহী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আজকাল আলু-পেঁয়াজের মতো মুদিদোকানে হরহামেশা কীটনাশক বিক্রি হচ্ছে। যেন কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’
No comments:
Post a Comment