Thursday, February 21, 2008

অতিথি নয় পরিযায়ী

উপরের পাখির ছবিগুলো ড. রেজা খান এর তোলা।

কয়েকদিন আগে প্রথমে আলোতে পরিযায়ী পাখি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ড. রেজা খান এর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির চুম্বক অংশ এখানে প্রকাশ করলাম।

পরিযায়ী পাখিরা বিদেশি পাখিনয়
ড. রেজা খান
(দুবাই চিড়িয়াখানার প্রধান)

পরিযায়ী পাখির ইংরেজি শব্দ হল মাইগ্রেটরি বার্ড। প্রাণীর ক্ষেত্রে মাইগ্রেশন এর সঠিক অর্থ সাংবাৎসরিক পরিযায়ন। তাই মাইগ্রেটরি পাখির বাংলা হবে পরিযায়ী পাখি। প্রত্যেক বছর এই পাখিগুলো বৎসরের কোন বিশেষ ঋতুতে পৃথিবীর এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে যায়। ঋতুশেষে আবার প্রথম অঞ্চলে ফিরে আসে। শুধু পাখি নয় কিছু প্রজাতির প্রজাপতি, হাঙর, মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে বাদুড়, চামচিকা, জেব্রা, গেজেল, ওয়াইল্ড বিস্ট, তিমি ও ডলফিনও পরিযায়ন করে।

পরিযায়ী পাখিরা সাংবৎসরিক যাতায়াত মূলত প্রজননকালীন অঞ্চল, যেমনসাইবেরিয়া এবং অন্য শীতকালীন অঞ্চল, যেমনসিলেটের হাওড় এলাকায় সীমিত রাখেপরিযায়ী পাখিরা নির্দিষ্ট একটি এলাকায় সব সময় না-ও যেতে পারেযেমনসিলেটের হাওরে না এসে চলে যেতে পারে; ধারেকাছের ভারতীয় এলাকা বা মিয়নমারেও
ধরুন, বামন চা পাখি বা লিট্ল স্টিন্ট সাইবেরিয়ায় প্রজননের পরপর অক্টোবরে দক্ষিণের দিকে ওড়া শুরু করেএদের একটি দল চীন, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, ভারত হয়ে পৌঁছায় বাংলাদেশের নানা এলাকায়অন্য দল চলে যায় রাশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ও চীন হয়ে জাপানের দিকেএদের আরেক দল ছোটে পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপে, সেখান থেকে আফ্রিকার দিকেধারণা করা হয়, এদের কিছু অংশ ভারত হয়ে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা করে বাংলাদেশ পেরিয়ে যায়
পরিযায়ী পাখিরা প্রধানত শীতের সময় এলেও অনেকে এ দেশে আসে বসন্ত ও শরৎকালেঅনেকে এ দেশে আসে কেবলই গ্রীষ্মশীতকালে পরিযায়ী পাখি বেশি চোখে পড়ে বলে সবাই এদের শীতের পাখি বলে ডাকে এই ভুল সম্বোধন পরিহার করা দরকার

পরিযায়ীদের নামবিভ্রান্তি
পাখি সম্পর্কে অজ্ঞানতার ফলে অনেকে পরিযায়ী পাখিদের অতিথি পাখি’, ‘মেহমান পাখিবা বিদেশি পাখিবলে আখ্যায়িত করছেনঅজ্ঞানতা এত দুর গেছে যে এক সাবেক প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী অতিথি পাখিরা কারও নিমন্ত্রণে আসেনি বলে সেগুলোকে মেরে খাওয়ার আহ্বান জানান!
পরিযায়ী পাখি বলতে বাংলাদেশে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় কেবল শীতকালে আসা হাঁস ও রাজহাঁসকেসাধারণ মানুষ শীতকালে জনপথে বিক্রি হওয়া কালিম, ডাহুক, কোড়া ও সরালী পাখিকেও শীতের পাখি মনে করেঅথচ এসব পাখি আমাদের দেশের বাসিন্দা বা রেসিডেন্ট প্রজাতিদেশে আবাসস্থলের অভাব হওয়ায় এরা এখন বেশির ভাগ সময় পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমারে কাটায়শীতকালে এরা সেখান থেকে আমাদের জলাভূমিতে নেমে আসেএদের কিছু নমুনা এখনো বাংলাদেশে প্রজনন করে

পরিযায়ী নানা পাখি
গুটিকয় চিল, শকুন ও বাজ বাদ দিলে আমাদের দিবাভাগের অনেক শিকারি পাখিই পরিযায়ী এদের মূল দল বাংলাদেশ পাড়ি দেয় শীতেমোহনা, হাওর অঞ্চল ও হাওরের বৃহত্তম ইগল (ইম্পেরিয়াল ইগল), বড় ও ছোট চিত্রা ইগল (গ্রেটার ও লেসার স্পটেড ইগল), বাদামি বা খয়েরি ইগল (স্টেপি ও টওনি ইগল) ও মেছো ইগল বা অস্প্রে দেখা যায় বেশ ; অন্যত্র ডোরাবুক ভুবনচিল (লাইনিয়েটেড কাইট), কাটুয়া চিল (বুটেড ইগল), বোনেলির ইগল (বোনেল্লিস ইগল), জলার চিল ও রাখালভুলানি (হ্যারিয়ার), কালো শকুন (সিনেরিয়াস বা ব্ল্যাক ভালচার), তুরমুতি ও শাহিন (ফ্যালকনস) ইত্যাদিনিশাচর শিকারি পাখির মধ্যে পেঁচারও কয়েকটি প্রজাতি পরিযায়ী
বড় বড় জলাশয়, হাওর, চর, মোহনা, উপকুলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলে হাজারে হাজারে আসত জলকবুতর, গঙ্গাকইতর, বদর বা বদরশাহর কবুতর ও গাঙচিলসমুদ্রসীমানায় কোনো জেলেপল্লী মানেই ছিল শত শত গঙ্গাকইতরের ভিড়জেলে নৌকা আর ট্রলারগুলোর পিছু নিত অসংখ্য গাঙচিলশীতের প্রধান জলচর প্রজাতিগুলো হলো গঙ্গাকইতর বা বদর (ব্রাউনহেডেড গাল), কালোমাথা গঙ্গাকইতর (ব্ল্যাকহেডেড গাল), জলকবুতর (ইয়েলোলেগ্ড গাল) ও বড় জলকবুতর (প্যালাসেস গাল)সবচেয়ে বেশি দেখা যায় গঙ্গাকইতরঢাকার বুড়িগঙ্গায় এদের দেখা যায় বেশএর পরপর আছে জলকবুতর
শরৎ বা বসন্তেও এ দুই প্রজাতিকে মোহনা অঞ্চলে ক্বচিৎ দেখা যেতে পারেজলকবুতর বা গঙ্গাকইতরের কোনো প্রজাতি আমাদের সীমানায় প্রজনন করে নাগাঙচিলের কিছু প্রজাতি এখনো প্রজনন করেকিছু প্রজাতি আগে করত, এখন আর করে না
খোঁপাযুক্ত মাঝারি গাঙচিল (লেসার ক্রেস্টেড টার্ন), খোঁপাযুক্ত বৃহৎ গাঙচিল (গ্রেটার ক্রেস্টেড টার্ন) ও বৃহৎ গাঙচিল (ক্যাস্পিয়ান টার্ন) দেখা যায় শুধু উপকুলীয় এলাকায়; মাঝারি গাঙচিল (কমন টার্ন) ও বড়ঠোঁটি গাঙচিল (গালবিল্ড টার্ন) বড় বড় জলাশয়েএরা সবাই আসে শীতে
বক, কোদালি বক, কাস্তেচরা, সারস, হাড়গিলা, মদনটাক, শামুকখোল ইত্যাদির লম্বা লম্বা পা, গলা আর ঠোঁট এদের বলা হয় ওয়েডিং বার্ডস, পানি কেটে বা ভেঙে চলা পাখিএদের মধ্যে পরিযায়ীর দলে পড়ে কোদালি বা খুন্তেবক (স্পুনবিল), কাস্তেচরার (আইবিস) দু-একটি প্রজাতি, সারসের (স্টর্ক) সব কয়টি প্রজাতি এবং মোহনা ও জলাভুমিতে দেখতে পাওয়া ধুসর বক (গ্রে হেরন)পরিযায়ী কাস্তেচরা ও সারস বিরল; বাকিরা সুলভ


প্রজননকারী পরিযায়ী
চাতক, পাপিয়া, সরগম, লালপাখা কোকিল, রঙিলা চ্যাগা, ঘুরঘুর খায়েরি ও সুমচার দলকে আমরা বিবেচনা করতে পারি প্রজননকারী পরিযায়ী পাখি হিসেবেএরা আমাদের দেশে আসে এপ্রিল-মে থেকে জুলাই-আগস্টেএদের মধ্যে প্রথম চারটি কোকিলগোত্রীয় এবং সব কয়টিই বাসা-পরজীবীঅর্থাৎ এরা নিজেরা বাসা বানায় না, অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়েসে বাসার পালক পাখি মা-বাবা ডিমে তা দেয়ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে নিজের বাচ্চা ভেবে কোকিলছানাদের খাইয়ে বড় করেবাচ্চা বড় হয়ে নিজের রূপ ধারণ করলে পালক মা-বাবা তাদের তাড়িয়ে দেয়পাখিরা তত দিনে মিয়ানমার বা ভারতে উড়ে যেতে সক্ষম হয়ে উঠেছে ঘটনা সাংবৎসরিকএসব কোকিল তাই পরিযায়ী পাখিআমাদের অতি পরিচিত কালো কোকিল, চোখ গেল, সরগম ও বউ-কথা-কও পাখি স্থানীয় প্রজাতি

আরও কত পাখি
আমরা সচরাচর দেখি না এমন অসংখ্য পরিযায়ী পাখি শরতের শেষে আসতে শুরু করেভরা শীতে তাদের আগমন তুঙ্গে ওঠে, ভাটা পড়ে বসন্তেএ দলে প্রধান হলো খঞ্জনি বা ওয়াগটেইল, তুলিকা বা পিপিট, কসাইপাখি বা শ্রাইখ, ফুটকি বা পাতাফটুকি, লিফ ওয়ার্বলার, চটক বা ফ্লাইক্যাচার, বঘেরি, মাঠচড়াই, ধুলচড়াই বা বান্টিং, ফিনচেস ও লার্কসদেশের যেকোনো বাগবাগিচা, উঠানের কামিনী, জবা, পাতাবাহার, জুঁই, গন্ধরাজ, গোলাপ, বাগানবিলাস, কাঠগোলাপ এবং অন্যান্য ফুল-ফলগাছের ওপর দিয়ে ও ক্ষেতখামার মাড়িয়ে চলে যায় এরাএরা আকারে ছোট, বেশির ভাগই বাবুই-চড়ুই পাখির মতোরং বাহারি নয় বলে আমাদের চোখেই পড়ে নাতাই ঝাঁকে ঝাঁকে আসা এসব পরিযায়ী পাখি আমাদের তালিকায়ও ঠাঁই পায় না
এসব পাখির একটিকেও বৈজ্ঞানিকভাবে ভিনদেশী বা অতিথি পাখি বলা যাবে নাকারণ, এরা আমাদের পরিবেশ ব্যবস্থার অচ্ছেদ্য অংশশীত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও হেমন্তে আমাদের ভূখন্ড এদের পাড়ি দিতেই হবেসময়মতো এরা ফিবছর আমাদের এখানে আসবে, সময়মতো চলেও যাবে

এবারের শীতের পরিযায়ী
সিডরের অপ্রত্যাশিত হামলার কারণে এবার শীতে যে শতসহস্র পরিযায়ী পাখি আমাদের হাওর, বাঁওড়, বিল, চরাঞ্চল, মোহনা ও কাপ্তাই হ্রদে এসেছে; তাদের খবর ফিবছরের মতো মিডিয়ায় তেমন জায়গা করে নিতে পারেনিসামান্য খবর যা হয়েছে, তার সবই প্রায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা সরালী হাঁস এবং একটি হাওরে পরিবেশ বিভাগের শীতকালীন পাখি গণনা নিয়ে
সচরাচর দেখা প্রজাতিগুলোর মধ্যে ঢাকার আশপাশের বিল, দিঘি বা হ্রদের প্রায় ৯০ শতাংশই সরালী, গেছোহাঁস বা লেসার হুস্টিলিং ডাক বা ট্রি ডাকসঙ্গে আছে দু-চারটি বড় সরালী বা ফুলভাস বা গ্রেটার হুস্টিলিং ডাক, চখাচখি, দু-একটি লেন্জা (পিনটেইল), বামুনিয়া হাঁস (কমন পোচারড), ভুতিহাঁস (ফেরুজিনাস ডাক), বড় ভুতিহাঁস (বেয়ারসস পোচারড), কালো হাঁস (টাফটেড ডাক), জিরিয়া হাঁস (গারগেনি), পিয়ং হাঁস (গ্যাডওয়াল), লালশির (উইজিয়ন), নীলশির (ম্যালারড), পাতারি হাঁস (কমন টিল), পান্তামুখী বা খুন্তেহাঁস (শোভেলার) ইত্যাদি

সরালী বাদে বাকিগুলো পরিযায়ী পাখিএরা আমাদের মিঠা ও লোনা পানির জলাভুমিতে আসেচলে যায় নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যেতিন-চার প্রজাতির রাজহাঁস আসে কেবল শীতে; বড় বড় নদীর চরে, মোহনায়, হাওরে, কাপ্তাই হ্রদেশাচকার একটি বড় দল দেখা যায় দেশের মোহনা ও উপকুলীয় এলাকায়ভুতিহাঁস, পিয়ং হাঁস, লালশির, বড় ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা খুন্তেহাঁস, চখাচখির বড় দল দেখা যায় বড় বড় হাওর, কাপ্তাই হ্রদ ও বড় নদীতেবোঁচা বা ঘড়যুক্ত হাঁস (কোম্ব ডাক) মূলত স্থানীয় পাখির প্রজাতি প্রজননের পরিবেশ লোপ পাওয়ায় এদের সংখ্যা এত কমেছে যে এরা এখন পরিযায়ীর দলে পড়েদেখাও যায় শীতের সময়ই বেশি
হাঁস, সরালী, রাজহাঁস, চখাচখি বাদ দিলে আর যে বড় পাখির দলটি শীতকালে আমাদের পানিবহুল অঞ্চল দিয়ে যায় বা ওখানে কিছু সময় থাকে, ওদের আমরা জলচর বা জলাভুমির পাখি হিসেবে জানি স্থানীয়ভাবে এদের পরিচয় চা-পাখি (স্যান্ডপাইপার স্টিন্ট), ঢেঙ্গা (শ্যাংক, স্টিল্ট), গুলিন্দা (কারলিউ), বাটান (প্লোভার), জৌরালি (গডউইট), জোয়ালা (রাফ অ্যান্ড রিভ), কাদাখোঁচা (স্মাইপ) এবং হট-টি-টি (ল্যাপউইং) হাঁস বা রাজহাঁস দেখা যাক বা না যাক, জলাভুমির পাখির কিছু নমুনাবিশেষ করে চা-পাখি, খঞ্জনি ও কসাই পাখিদেখা যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পুকুর, থানচি, বান্দরবানের গির্জার ছোট্ট চৌবাচ্চায়
সবার কাছে তাই আবেদন, শীতকালে দেখা বা বিভিন্ন ঋতুতে স্বল্প থেকে দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশে ঠাঁই নেওয়া পাখিগুলোকে অতিথি পাখি, শীতের পাখি বা বিদেশি পাখি বলে আখ্যায়িত করে তাদের যেন আমরা পর করে না ফেলিএরা শীত, বসন্ত, শরৎ বা গ্রীষ্মের পরিযায়ী পাখিএ দেশেরই পরিযায়ী পাখি, এ দেশের প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাণচক্রের অচ্ছেদ্য অংশ, আমাদের জাতীয় প্রাকৃতিক বন্যপ্রাণী-সম্পদের এক বড় হিস্যা




No comments:

Post a Comment