গত শুক্রবারের প্রথম আলোর অন্য আলো পড়ছিলাম। পাখি বিশারদ শরীফ খান সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। তার জীবন ভাবনা, পাখি বিষয়ক আগ্রহ, কর্ম পরিধি সবকিছু সম্পর্কে সংক্ষেপে ভাল তথ্য পেলাম। তিনি আগে পাখি মারতেন। বাড়িতে বাবা-মা দুজনই পাখি শিকারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শরীফ খান নিজেও অসংখ্য পাখি শিকার করতেন। তার সবগুলোই যে প্রয়োজনে করতেন তা নয়। বেশিরভাগ সময় আনন্দের জন্য শিকার করতেন। কিন্তু একদিনের ঘটনা তার মনে এমন প্রভাব ফেলল যে তিনি সেদিন থেকে পাখি শিকার নয় পাখি রক্ষায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন। একদিন তিনি একটি ঘুঘু পাখিকে গুলি করলেন। যথারীতি পাখিটাকে গুলি লাগল। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে মাটিতে পড়ে না গিয়ে সেটা গাছের কোন একটি জায়গায় গিয়ে আটকে গেল। শরীফ খান পাখিটাকে পাড়তে গিয়ে দেখেন যে সেটা মা পাখি। বাসায় তার তিনটি বাচ্চা। তখনও চোখ ফোটেনি। মা পাখিটা সেখানে মরে পড়ে আছে। ছোট্ট ছানাদের শরীর রক্তে মাখামাখি। তার নিজের ভাষায়- "সাবধানে পাতার ঝোপ ফাঁক করে দেখি ছোট্ট তিনটি বাচ্চা, এখনো চোখ ফোটেনি। চোখে দেখে না, খাবারের জন্য হাঁ করতেছে তারা। মায়ের রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে শরীর, বীভৎস দৃশ্য। মৃত পাখিটাকে ওদের কাছে রেখে এলাম। ওই শেষ, শিকারজীবনের ইতি। ওই দৃশ্য আমি আজও ভুলিনি। এরপর থেকে অন্যদেরও শিকার করতে বারণ করা শুরু করি। একটা সময় পাখি ও বন্যপ্রাণীর চরম সর্বনাশ করেছি। তাই এখনো পাখিদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমা চাই বন্যপ্রাণীদের কাছে, প্রকৃতির কাছে।" সত্যিই শরীফ খানের অভিজ্ঞতা মর্মস্পর্শী। একসময় আমিও পাখি শিকারে যেতাম। সে অন্যরকমের এক নেশা। তবে বড় হবার সাথে সাথে বিভিন্ন পাখি বিষয়ক বই পড়ে আমি সচেতন হয়েছি। এখন আর পাখি শিকার করিনা। পাখি শিকার করতে অন্যদের অনুৎসাহিত করি। আসলেই আমরা পাখিদের কাছে যে অপরাধ করেছি তা ক্ষমাহীন। ইউরোপ আমেরিকায় বন্যপ্রাণীদের সাথে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের। আর আমরা এখনও তাদেরকে শত্রু কিংবা দাস ছাড়া অন্য কিছু মনে করিনা। তবে যত দিন যাচ্ছে, মানুষ ততই সচেতন হচ্ছে। সরকার বা বিভিন্ন সচেতন গোষ্ঠীদের কর্মতৎপরতা বাড়ছে। শরীফ খানের একটা কথা খুব প্রণিধানযোগ্য। "প্রত্যেক থানায় সরকারি যে খাসজমি আছে তা থেকে পাঁচ বিঘা করে যদি ফেলে রাখা হয়, তাহলে আপনাআপনি যে জীববৈচিত্র্য হবে, তা হাজার বছরেও হবে না।" বিষয়টি ভাববার ও করবার মত। শরীফ খানকে আইডিয়াটির জন্য ধন্যবাদ। প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশে পাখি বিপন্ন হবার কারণ একাধিক। এ সম্পর্কে শরীফ খান বলেন -"একটা পাখি টিকে থাকতেহলে চারটা জিনিস দরকার: নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য, বাসা বাঁধার জন্য গাছ ও বিচরণভূমি। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া পৃথিবীর কোনো পাখিই তাকার জন্য বাসা বাঁধে না। তারা ডিম, বাচ্চ দেওয়া অর্থাৎ বংশবৃদ্ধির জন্যই বাসা করে। আমাদের দেশে জলাভুমি কমে যাচ্ছে, তাই বিপন্ন হচ্ছে বালিহাঁস। মরা তালগাছ, সুপারি গাছে বাসা বাধে টিয়া, শালিক, বসন্তবৌরি। এখন মরা গাছ সঙ্গে সঙ্গে কেটে ফেলা হয়। জলময়ুর বাসা বাধতে পারছে না। জলপিপির নেই চারণভূমি। খাদ্য সংকটে আছে ধূসর মাথা হট্টিটি। ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষক্রিয়ার শিকার হচ্ছে পাখি।....'৭৪ থেকে যেকোনো ধরণের পাখি, বন্যপ্রাণী দরা, মারা পোষা আইনত নিষিদ্ধ। যেদেশে পাখি শিকার নিষিদ্ধ, সেই দেশে এয়ারগান ও পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল বিক্রি হয় কীভাবে?" ঠিক প্রশ্ন করেছেন শরীফ খান।
পাখি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় শরীফ খানের তৎপরতা অনেক। পাখি নিয়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য লেখা তো লিখে চলেছেন এছাড়া দুটো ডকুমেন্টারি ভিডিও চিত্র তৈরি করেছেন। নাম 'হালতি পাখির বাসা' ও 'হালতি নামা '০৭'। দুর্লভ পাখি হালতি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য, তাদেরকে রক্ষা করার জন্য তিনি ভিডিওচিত্র দুটি তৈরি করেছেন। এছাড়া গড়ে তুলেছেন 'বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাব, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমিতি। তাদের উদ্যোগে করা হয়েছে শিশুদের সংগঠন লাভ বার্ড ক্লাব ও লাভ ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাব।
শরীফ খানের উল্লেখযোগ্য বই হল বাংলাদেশের পাখি। এই বইয়ে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে পরিযায়ী পাখি রয়েছে ২০০ প্রজাতির। বিভিন্ন পাখির বর্ণনা ছাড়াও তাদের আচার আচরণের তথ্যমূলক বিবরণ রয়েছে বইটিতে।
সম্পূর্ণ ফিচারটি পড়ে ভাল লেগেছে।
No comments:
Post a Comment