Friday, May 30, 2008

শতবর্ষী বলধার সৌন্দর্য ও সমস্যা

সমকাল পত্রিকা বলধা গার্ডেনের শত বৎসর উদযাপন উপলক্ষে আজকের কালের খেয়াতে প্রখ্যাত প্রকৃতিপ্রেমিক বিপ্রদাশ বড়ুয়ার একটি লেখা প্রকাশ করেছে। সেটা পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এখানে পুন:প্রকাশ করলাম।

বিপ্রদাশ বড়ূয়া

বলধা গার্ডেনের রচয়িতা বলধার জমিদার প্রকৃতিপ্রেমিক নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী। ১৯০৯ সালে এই স্বপ্নযাত্রা শুরু। ১৯৩৬ সালে ২৭ বছরের চেষ্টায় বলধার সাইকি অংশের রচনা সমাপ্ত হয়। পরের বছর সাইকির মুখোমুখি অংশ শঙ্খনিধির ব্যবসায়ী লালমোহন সাহা থেকে ক্রয় করে নেন। সেই অংশের নাম হয় সিবিলি। নবাব স্ট্রিটের দুই পাশে বলধা গার্ডেন অবস্থিত। সিবিলি নির্মাণ শুরু হয় ১৯৩৮ সালে। সেখানে যে বাঁধানো সুন্দর পুকুরটি আছে তার শঙ্খনিধি নাম নরেন্দ্রনারায়ণ অপরিবর্তিত রাখেন। এ বছর সিবিলির উত্তরের সীমানা দেয়ালের কাছের ৭০ বছুরে পাম (করিফা এলাটা) গাছটিতে ক্রিম-সোনা রঙের ফুল ফুটে চিত্রিত হয়ে আছে। বলধা গার্ডেনের শতবর্ষে এ যেন প্রকৃতির অনন্য উপহার। এক বছর ধরে এই ফুল থেকে বীজ হবে, পাকবে। মাত্র একবার অজস্র সন্তানের জন্ম দিয়ে তবেই মা-গাছের ছুটি। সন্তানের জন্য এই ৭০ বছর বেঁচে থাকা, অথবা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মায়ের মৃত্যুরূপ সুখ এলো, এ যেন মরার জন্যই এতদিন বেঁচে থাকা। বলধার শতবর্ষে এই পাওয়া অনেক অনেক।
বলধার সিবিলি অংশ মূলত রচিত হয়েছিল সাইকির বীজতলা বা নার্সারি হিসেবে। নরেন্দ্রনারায়ণ নিজেই এই বাগানের নকশা প্রণয়ন করেন। অমৃতলাল আচার্যকে তিনি এর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। বাগানের সব গাছের নাম, পরিবার, কোথা থেকে আনা হয়েছে, কীভাবে সংগৃহীত হয়েছে, কখন রোপণ হয়েছে সবই তাঁর মুখস্থ। তাঁকে সত্যিকার অর্থে বলধার জীবন্ত কোষগ্রন্থ বলা হতো। বাগান সম্পর্কিত যে কোনো প্রশ্ন তাঁর জানা।

অমৃতলাল আচার্য ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তাঁর বাবার সাহচর্য ছিল মি. প্রাউডলকের সঙ্গে। প্রাউডলক ছিলেন ইংরেজ, তিনি রমনা এলাকার বৃক্ষ ও পুষ্পবিন্যাস রচয়িতা। আজকের রমনার শতাব্দীর বৃক্ষ ও রাস্তার ধারের বীথি তাঁরই রচনা। এ সময় ভাইসরয় ছিলেন লর্ড কার্জন। তখন বঙ্গভঙ্গ হয়ে বিভক্ত বাংলার রাজধানী হয় ঢাকা। বাঙালি জাতীয়তাবাদী অমৃতলাল আচার্য জেলে যান এবং প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু প্রকৃতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও অনুসন্ধিৎসা তাঁকে নরেন্দ্রনারায়ণের কাছে নিয়ে যায়। ১৯৩৬ সালে অমৃতলাল বলধার সুপারিনটেন্ডেন্ট নিযুক্ত হন। তাঁর যোগদানের পরপরই নরেন্দ্রনারায়ণ শঙ্খনিধি জমিদার লালমোহন সাহা থেকে সিবিলির জায়গাটি কিনে নেন। এভাবে সাইকি ও সিবিলি নামে মুখোমুখি দুই দেবীর নামে দুটি বাগান রচিত হয়।
এই বাগানের গাছ রোপণের উদ্বোধন হয় চম্পা (মিচেলিয়া চম্পক) গাছ রুয়ে। এই গাছের বীজ থেকে চারা করেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ অমৃতলাল। পরে এর আগা ভাঙা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের পরেও বেঁচে ছিল। এটি ছিল শঙ্খনিধি পুকুরের পুব দিকের অলঙ্কৃত শান বাঁধানো ঘাটের পেছনে। সামনেই রয়েছে ঐতিহাসিক সূর্যঘড়ি।

সাইকির বর্তমান প্রবেশপথ নবাব স্ট্রিটের দিকে দক্ষিণমুখী। আদিতে ছিল এর ঠিক উত্তর দিকে, তার নাম ছিল সিংহ দরজা (লায়ন গেট)। বর্তমানে দক্ষিণ দিকে ঢুকে সোজা চলে গেলে দু’ধারে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম উদয়পদ্মের (ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা) সারি। আদিতে এখানে ২০টি গাছ ছিল। এই বাগানে দুটি বড় গ্রিনহাউস রয়েছে। শঙ্খনিধি পুকুরে উত্তর-পুব ধারে একটি, এটি বলধার সবচেয়ে বড় গ্রিনহাউস। এখানে প্রচুর অর্কিড ও বিদেশি গাছের সমাবেশ। অনেক দুর্লভ উদ্ভিদ এখানে আছে। বিশেষভাবে তৈরি বেড, ঝুলন্ত ও মাটিতে এরা বর্ধিত হচ্ছে। হালকা আলোয় এদের পাতা ও ফুল দারুণ সুন্দর। মাথার ওপর লোহার জাল ও বাঁশের ফালিতে রোদ প্রতিহত হচ্ছে। প্রাগৈতিহাসিক এসব উদ্ভিদ দর্শকদের বিভোল করে দেয়। বার্ডস অব প্যারাডাইস যা অষ্ট্রেলিয়ার কোয়ান্টাম বিমানের মনোগ্রাম দর্শকদের আবার মর্তে নিয়ে আসবে।

দ্বিতীয় গ্রিনহাউসটি রয়েছে লায়ন গেটের কাছে উত্তর দেয়াল ঘেঁষে। এটি মহৃলত পামগাছের চারা করার জন্য তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে বিভিন্ন রকমের ফার্ণ রয়েছে এখানে।
আগে উত্তর-পুব দেয়ালের পাশে ছিল একটি বাওবাব গাছ (এডানসোনিয়া ডিজিটা)। এই গাছ আবিষ্কৃত হওয়ার আগে আমেরিকা সেকোয়া জায়গানটিকা ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম গাছ। বাওবাব মধ্যে আফ্রিকার গাছ, এর বিশালত্ব না দেখে অনুমান করা কঠিন। ফরাসি উদ্ভিদবিদ এডানসনের নামে এর বৈজ্ঞানিক নাম হয়েছে এডানসোনিয়া। তিনি নিজে গণনা করে আফ্রিকায় এমন বাওবাব গাছ দেখেছেন যার বয়স ৫ হাজার বছরের ওপর। বর্তমানে রমনাপার্কে তিনটি ও ধানমণ্ডি লেকের কাছে একটি বাওবাব আছে, সিবিলির গাছটি মরে গেছে। মিসরের ফারাওদের আগে মধ্য আফ্রিকার আদি বাসিন্দারা এর গর্তে মৃতদেহ রেখে দিত, এবং এর স্বাভাবিক রসে মৃতদেহ মমি হয়ে যেত। মিসরীয়রা সম্ভবত এই গাছের রস থেকে মমি করার উপাদান সংগ্রহ করত।
উত্তরের এই ফার্ণ হাউসের সঙ্গে আছে এক সারি বাঁধানো টব-পুকুর। মাটিতে চার-পাঁচ ফুট গভীর এই বাঁধানো টব-পুকুরে শাপলা আছে। তার দক্ষিণে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা আছে ক্যামেলিয়া (ক্যামেলিয়া জাপোনিকা), যার আকার আকৃতি চা-গাছের (ক্যামেলিয়া চাইনেনসিস) মতো। এখানে ছয়টি ভিন্নরকমের ক্যামেলিয়া গাছ আছে। এদের ফুলের রং তুষার-ধবল থেকে তীব্র লাল। চা-গাছ বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতা দিয়ে ক্যামেলিয়া চারা রুয়ে সফলতা পাওয়া যায়। এখনো পর্যন্ত একমাত্র বলধায় ক্যামেলিয়া গাছ আছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এতে ফুল দেখা যায়। ক্যামেলিয়া প্রথমে সাইকিতে পূর্ব-দক্ষিণ কোণের দিয়ে রোপণ করা হয়েছিল। পরে সিবিলিতে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা ঘরে স্থানান্তরিত হয়। আর তার চালের ওপর একটি আঙুর লতা দেওয়া হয়। তার বয়সও অর্ধশতাব্দী হতে পারে, লতার মোটা শরীর দেখে এই অনুমান করা যায়। গত শীতে আমি এর তুষার-ধবল ও গোলাপি-লাল দু’রকম ফুল দেখি ও ছবি তুলেছি। সমকালে সাদা ফুলের ছবিসহ লেখা ৫ এপ্রিলে ছাপা হয়েছে। ক্যামেলিয়ার সঙ্গে সামুরাই যোদ্ধাদের গভীর সম্পর্ক ও কুসংস্কারের কথা সেখানে বলা হয়েছে।
সিবিলি উদ্ভিদতত্ত্বের গবেষণার জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ বাগান। বসন্ত থেকে গ্রীষ্মে এখানে ফোটে বহুবর্ণের বিচিত্র সব ফুল, বর্ষা পর্যন্ত তার ঢেউ চলে কৌতূহল ও বিশ্রম্ভালাপ করে করে। নানা রকম ব্রাউনিয়া, অশোকেরা, উদয়পদ্ম, স্বর্ণচাঁপা, মুচকুন্দ, খয়ের, কেয়া, অরুণ (কর্ডিয়া সেবাস্তানা), সুষমা (ব্রনফেলসিয়া), বসন্ত রঞ্জিনী (ক্যাশিয়া নভোজা), মাধবী, মধুমালতী, উলটচণ্ডাল, কাঠচাঁপা, টিউলিপ বা রুদ্রপলাশ, পলাশ, শ্বেতশিমুল, সোনালু, সজনে, কাঞ্চন, নাগকেশর প্রভৃতি কত কত ফুল! বিদেশি অনেক ফুলের তালিকা দেওয়াই হলো না। আরো কত কত দেশজ ফুল! বলধার দেড় হাজার গাছপালার তালিকা কি দিয়ে শেষ করা যায়!
প্রবেশ পথের ভেতরে ডান দিকে এগিয়ে গেলে আছে ভূর্জপত্র (যার থেকে এককালে হাতে তৈরি কাগজ হতো), নাগকেশর, পান্থপাদপ, পলাশ, নাগলিঙ্গম, গর্জন ইত্যাদি মূল্যবান গাছ। তারই নিচে সবুজ চত্বরে প্রকৃতিপ্রেমিকের চিরনিদ্রাবৃত সমাধিফলক। এর দক্ষিণ দিকে আছে বিখ্যাত আঞ্জীর (ক্যালিফোর্নিয়ান ডুমুর) গাছ, দু’বছর আগেও ছিল, বড় গুঁড়ি নিয়ে কম ডালপালাসহ আট-দশ ফুট উঁচু সমীহ আদায়কারী, বাংলাদেশে আর কোথাও এই গাছ ছিল বা আছে কি-না জানা নেই। এর ফল যজ্ঞ ডুমুরের চেয়ে বড়। শীতের দেশে এই ফল হয়, অত্যন্ত সুস্বাদু, ঢাকায় আমদানি করা আঞ্জীর খেয়েছি বছর দশেক আগে। ঢাকায় সেবার বাণিজ্য মেলায় ইরানি স্টল থেকে কিনেছিলাম। কলকাতার নিউ মার্কেটে কাশ্মীরের ভালো আঞ্জীর পাওয়া যায়। খাওয়ার সময় আঞ্জীরের ভেতরের অজস্র ছোট ছোট বীজ মুখে কচ কচ করবে। খাওয়ার আগে ভেতরটা সাফ করে নিলেই ব্যস! জাপানের শুকনো পার্সিমোন ফল, আরবের উন্নত খেজুরের ভগিনীসম বা তার চেয়ে উৎকৃষ্ট আস্বাদ পাবেন। সেই গাছটি কেটে সেখানে ছোট পাকা একটি ঘর করেছে। এই অনাচার, নষ্ট পরিকল্পনা কোনো যুক্তিতে মানা যায় না।

সিবিলি সেনচুরি প্লান্টের জন্যও বিখ্যাত। আমেরিকার এই ক্যাকটাসে ফুল আসে দীর্ঘ দশ-কুড়ি বছর পর, এজন্য এদের নাম হয়েছে সেনচুরি ফ্লাওয়ার। সিবিলির শঙ্খনিধি পুকুরের পশ্চিম পাড় এদের স্বর্গ। এখানে আছে ৬০-৭০ বছুরে কেয়া ঝাড়, তাদের শুলো বা ঠেস মূল দেখে দেখে আশ মেটে না। তার পাশে পুকুরের ধাপে ধাপে বাঁধানো পাড়ে তরুণ-তরুণীদের অবাধ স্বাধীনতাও চোখে পড়ে। আর তাদের গুনগুন স্বপ্নালাপ ও অস্ফুট কাকলি গানের ঐশ্বর্য নিয়ে ফিরে তাকাই জয় হাউসের দিকে।

ছোট্ট জয় হাউস। শঙ্খনিধি পুকুরের পশ্চিম ঘাটের সুচারু সিঁড়ির উপরে এক কক্ষের ঘর। নিচে প্রায় খালি। এক কক্ষ ঘরটির সামনে উন্মুক্ত স্থানসংবলিত মনোরম চৌকো এক এম্পিথিয়েটার হল যেন। একই সঙ্গে এখান থেকে সম্পূর্ণ গভীর পুকুরের সব ধাপ ও পুরো বাগান দেখা যায়, চারদিক দেখার মানমন্দিরতুল্য সরল সৌন্দর্যের আধারবিশেষ।

পশ্চিমের দেয়ালের পাশে আছে রস্ট্রেটা কলাবতী ও বার্ড অব প্যারাডাইস (স্টেলিৎজিয়া রেজিনায়ে)। তারপর আরো দক্ষিণে গেলে বাঁয়ে আছে আর একটি গ্রিনহাউস, এখানে আদিতে তাপনিয়ন্ত্রণ করে অমূল্য চারা সংরক্ষণ, বর্ধন ও চারা তৈরির প্রচেষ্টা হয়। এখন এখানে চারা তৈরি করা হয়। তারপর ভবন কোনায় শৌচাগার ফেলে বাঁ দিকে ঘুরতেই দেয়ালের গায়ে আছে একটি কৃষ্ণবট বা মাখন কটোরি। অদ্ভুত এর পাতার গঠনশৈলী। লম্বা বোঁটার মাথায় পাতার গোড়ায় আছে দু’পাশ থেকে পাতা এসে একটি ঠোঙ্গা গঠিত হয়েছে। এতে শ্রীকৃষ্ণ বালক বয়সে ননী রেখে খেতেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। তারপর পাতাটি লম্বা হয়ে গেছে, পাতার আগা তীরের ফলার মতো লম্বা আর পাতাটি দর্শনযোগ্য শিরাবহুল।

বাঁ দিকে আছে কাউ (গার্সিনিয়া কোয়া), পাকলে সোনার রঙ হয়ে যায়। গ্রামে খেয়েছিলাম মনে আছে? তার পাশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল বৃক্ষ চাপালিস (আর্টোকার্পাস চাপালামা)। পরিপূর্ণ বড় হলে দৈত্যাকার। এর ফল বাতাবিলেবুর সমান, একরকম কাঁঠাল, প্রচুর কোয়া থাকে, বীজ কাঁঠাল-বিচির তুল্য ও খাদ্যগুণে ভরপুর। এর কাঠ কুঁদে বড় নৌকা হয়, কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র হয়। পাশে আছে ডেউয়া। এখানে দুটি প্রাচীন ইউক্যালিপটাস ও বড় একটি মুচকুন্দ এবং তার চেয়ে ছোট একটি মুচকুন্দ। আরো কত গাছ, কত কাহিনী।
তারপর প্রবেশপথ। এখানে ভূর্জপত্র, নাগকেশর, পান্থপাদপ কত সৌন্দর্য রচনা। কত অনাদর ও অবহেলাই না সহ্য করতে হয় মানুষের হাতে রচিত বাগানকে! সাইকি রচনা শুরু হয় ১৯০৯ সালে, সমাপ্ত হয় ১৯৩৬ সালে। সাইকির পরিকল্পনা নরেন্দ্রনারায়ণ করেছেন। রূপায়ণকারী অমৃতলাল আচার্য। এর গঠনশৈলী থেকে উদ্ভিদের সমাবেশ সবকিছু লিখতে গেলে এক কাহন পাতা হয়ে যাবে। কাহন হলো প্রাচীনকালে এক টাকা, ষোলো পণ কড়ি বা দ্রব্য অর্থাৎ ১ হাজার ২৮০টা। বলধা নিয়ে এক কাহন পৃষ্ঠার বই লেখা যায়। এখন সেদিকে না গিয়ে সাইকির প্রধান প্রধান বিশেষত্ব চুম্বকে ধরা যাক।
সাইকি ঢুকেই বাঁ দিকে প্রথম পড়বে পাম গাছটি, তার গায়ে প্রেম ভরে আলিঙ্গনাবদ্ধ আছে লতাবট। দু’পাশে টব পুকুরে শাপলা ও পদ্ম, জলকেলি বন্ধ করে দিয়েছে আমাদের ঢুকতে দেখে যেনবা। তারপর বাঁয়ে ঘৃতকুমারীর ঘর। এখন আছে দু’রকম, আগে বহু রকম ছিল। ঘরের লোহার জালে আটা লতাবটের জাফরি ছিল। এক সময় তার সামনে পান রুয়ে ছিল, এখন আছে টবে। আপনিও পারেন টবে পান করে গৃহশোভা ও গৃহীর মর্যাদা বাড়িয়ে তুলতে। এমনকি মাটির বড় গামলায় কচুরিপানা রেখে দেখুন না! অথবা মহিশখাইল্যা পান, অথবা জসিম উদ্দীনের মামাবাড়ির সাঁচি পান, অথবা আপনার প্রিয় গ্রামের বরজের পান।
এরি মধ্যে আমাজন নদীর জলভূমিতে আবিষ্কার করা আমাজন লিলির টব-পুকুর ফেলে এসেছি, সামনে বিচিত্র বকুলের পাশে আর একটি আছে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আমাজান আবিষ্কার করেন রানী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালে। এ জন্য এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো ভিক্টোরিয়া রিজিয়া।

এখানে আছে তিনটি ক্যাকটাস ঘর, দুটি ফার্ণ ঘর। দক্ষিণ প্রান্তের ফার্ণ ঘরটির গঠনশৈলী দারুণ আয়তাকার ঘরের পুব প্রান্ত উঁচু, নিচে একটি ঘর, তাতে নানা যন্ত্রপাতি ও বীজ থাকে। পশ্চিম দিকটি মাঝখান থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে এবং উপরে বসে বিশ্রাম সুখসেবা গ্রহণ করা যায়। তার নিচে আছে একটি পাথুরে সুড়ঙ্গ, যেন আদিম যুগের কোনো মুলুকে এসে পড়েছি। আমি যতবার এই সুড়ঙ্গ দেখেছি ও তার ভেতর দিয়ে গেছি শিহরণ অনুভব করেছি। বলধার এই অমেয় অনুভূব নিয়ে লিখেছি ‘অন্তর ও বাইরের ডাক’ গল্প, এটি সংকলিত হয়েছে ‘আমি একটি স্বপ্ন কিনেছিলাম’ গল্পগ্রন্থে।
এখানে আছে ভূতনাগিনী উদ্ভিদ। তার বীজের অদ্ভুত গন্ধ শুকিয়ে ধ্রুব এষের তিন দিনের মাথাব্যথা সারিয়ে দিয়েছি। সিন্দুরি বীজ দিয়ে এক তরুণীর হাতের সব নখ কামনা রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিলাম, ওর প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কঠিন সলজ্জ বাধার জন্য পায়ের নখ রাঙিয়ে দিতে পারিনি। এর স্বর্ণঅশোক, প্যাপিরাস ঘাস, বিচিত্র বকুল- আরো কত রয়ে গেল। সিকি কাহনও বলা হল না। বলধা আমার শিক্ষক, আমার আবেগ ও উদ্বেগ। এক শ’ বছর তো কোনো মতে গেল। ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য আরেক শতাব্দী থাকবে তো?

বলধা বাগানের সংগ্রহের সংক্ষিপ্ত তালিকা

আজকের প্রথম আলো পত্রিকায় বলধা গার্ডেনের সংগ্রহের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এখানে তা পুন:প্রকাশ করলাম।

বাগানের যত সংগ্রহ
সাইকি ও সিবিলি মিলিয়ে বাগানে ৮৭ পরিবারের ৭২০ প্রজাতির ১৭ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে। সাইকির প্রবেশপথের দুই পাশে প্রথমেই শাপলা ও পদ্মপুকুর। সেখানে ১২ প্রজাতির জলজউদ্ভিদ রয়েছে। দুর্লভ শাপলার মধ্যে হলুদ শাপলা ও থাই বেগুনি শাপলা উল্লেখযোগ্য। আরেকটু সামনেই ডান দিকে রোজক্যাকটাস, প্যাপিরাস, কনকসুধা। বাঁ দিকের ঘরে আছে ঘৃতকুমারী। তারপর ওষুধি গাছগাছড়া, আমাজন পদ্ম, পদ্ম, অর্কিড ঘর, হংসলতা, পাশেই জমিদারের বাড়ি ও জাদুঘর। অফিসঘরের দক্ষিণ পাশেই জ্যাকুইনিয়া, শারদমল্লিকা, কণ্টকলতা, গুস্তাভা, হিং, শ্বেতচন্দন, সাইকাস, স্বর্ণ অশোক, কুর্চি, ভুর্জপত্র। ডান দিকে ক্যাকটাসের দুর্লভ সংগ্রহ নিয়ে একটি ঘর। এখানে ক্যাকটাস ঘরের সংখ্যা তিনটি, পটিংঘর একটি, ছায়াঘর দুটি, অর্কিডঘর একটি। মাঝখানে চারদিকে তাকসমেত পিরামিড আকৃতির একটা ঘর। তাকগুলোতে থরে থরে সাজানো ক্যাকটাস। দক্ষিণ প্রান্তে ছায়াঘর, সেখানে রয়েছে নানা জাতের ফার্ন। স্বর্ণ অশোকের পাশেই সাদা ও গোলাপি ক্যামেলিয়া, তারপর রাজ অশোক। বাঁ দিকে উলটচন্ডালের হলুদ জাত, দক্ষিণ দিকের দেয়ালের পাশে ছোট জাতের কয়েকটি পাম। ছোট-বড় মিলিয়ে সাইকিতে ১৬ প্রজাতির পাম রয়েছে। শরতের মাঝামাঝি থেকে একটি পরিচয়হীন লতানো গাছে হলুদ রঙের ফুল ফোটে, থাকে অনেক দিন। সাইকির বিরলতম সংগ্রহের মধ্যে আরও আছে লতাবট, লতাচালতা, ক্যানেঙ্গা, ঈশ্বের মূল, নবমল্লিকা, ওলিওপ্রেগরেন্স, জিঙ্গো বাইলোবা, অ্যারোপয়জন, র‌্যাভেনিয়া, আফ্রিকান বকুল, নাগলিঙ্গম, উদয়পদ্ম, রাজ অশোক ইত্যাদি।
উদয়পদ্মে সুসজ্জিত সিবিলির প্রবেশপথ। এ বাগানেই আছে মনোলোভা সব ক্যামেলিয়ার ঘর। বাঁ পাশে পুকুরের কোনায় আছে সুউচ্চ মুচকুন্দ আর ডান পাশে পোর্টল্যান্ডিয়া। আরেকটু এগোলে চোখে পড়বে কলকে, অ্যারোপয়জন, কপসিয়া, হলদু, দেবকাঞ্চন, কনকসুধা, কনকচাঁপা, লতা জবা, স্কারলেট কর্ডিয়া, কাউফল। শঙ্খনিধি পুকুরে নানা জাতের জলজ ফুল। পথের শেষপ্রান্তে আছে কয়েকটি দুর্লভ রাজ অশোক, বাঁ দিকে ঘুরলে রুদ্রপলাশ, অপরিচিত পাম, গড়শিঙ্গা, ক্যামেলিয়ার ঘর, দেয়াল লাগোয়া পশ্চিম পাশে একসারি ক্যানেঙ্গা ও ইয়ਆা, দুই জাতের কেয়া ইত্যাদি। এ বাগানের দুটি ঘরের একটিতে অর্কিড, অন্যটি চারাগাছের ভান্ডার। শঙ্খনিধি পুকুরের পশ্চিম পাড়ের দোতলা ঘরটি এখন পরিত্যক্ত। এখানে আরও আছে মাধবী, অশোক, পিয়াল, পান্থপাদপ, শতায়ু উদ্ভিদ, পাখিফুল, কৃষ্ণবট ইত্যাদি। এ বাগানের গোলাপ একসময় উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ ছিল।

বলধার ছিন্ন স্মৃতি

বলধা গার্ডেনের শত বৎসর পূর্তি উপলক্ষে আজকের সমকাল পত্রিকার কালের খেয়া সংখ্যায় বরেণ্য প্রকৃতিপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লেখাটি এখানে পুন:প্রকাশ করছি।

দ্বিজেন শর্মা

বলধাবাগানের সঙ্গে হার্দ সম্পর্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সেই ১৯৫৬ সাল থেকেই, যখন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সেখানে যাতায়াত ছিল বাধ্যতামূলক। কার্জন হল চত্বরের ক্ষুদে বোটানিক উদ্যান ছাড়া তখন ঢাকায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ সংগ্রহ ছিল শুধু বলধায়। সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক অমৃতলাল আচার্যের সঙ্গে পরিচয়, যা পরে নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। বলধাবাগানের তখন দারুণ দুর্দিন, জমিদারি উচ্ছেদের পর অভিভাবকহীন। মালীরা বেতন না পেয়ে উধাও, অমৃতবাবু হয়েছেন তাদের বদলি; কিন্তু ১৫-২০ জনের কাজ তার সাধ্যাতীত। তাই মারা পড়ে অনেক মূল্যবান দুর্লভ বিদেশি প্রজাতি। সরকার বাগানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে চেয়েছিল রক্ষণাবেক্ষণের কোনো মঞ্জুরি ছাড়া। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এ দায়ভার গ্রহণ সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত বন বিভাগের ওপর এটির দায়িত্ব বর্তালে সরকারি চাকরির আশায় মালীরা কাজে ফেরেন এবং বাগানটিও রক্ষা পায়; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি না থাকায় অমৃতবাবুর চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। শেষে তার বন্ধু অধ্যাপক মুয়ায্যম হুসাইন খান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে তাকে স্বপদে বহাল রাখার ব্যবস্থা করেন। তাতে বাগানটিও উপকৃত হয়। কেননা এ পদে তার স্থলবর্তী হওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি সেকালেও ছিলেন না, একালেও দুর্লভ।
অমৃতবাবুকে এড়িয়ে বলধাবাগানের বিবরণ পূর্ণ হওয়ার নয়। তার পিতা শ্যামলাল আচার্য ছিলেন শ্যামলী রমনার স্থপতি প্রাউডলক ও অখিল চন্দ্র চক্রবর্তীর কর্মী দলের সদস্য। জন্মনিসর্গী অমৃতলাল নজরে পড়েন বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর। তিনিই তাকে প্রশিক্ষিত করেন এবং বাগান দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। কোনো অবস্থাতেই বাগান ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন আর অমৃতবাবু তা মান্য করেছেন ক্যাসাব্লাঙ্কিয় নিষ্ঠায়। পাকিস্তানি আমলের একাধিক মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালেও বাগানেই থেকে গেছেন তিনি। চিরদিন স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন। তাই বাগানটি সরকারিকরণের পরবর্তী পরিস্থিতিতে বড় বেশি সন্ত্রস্ত থাকতেন, ভয় পেতেন আমলাদের। ১৯৭৪ সালে মস্কো যাওয়ার আগে আমার উদ্যোগে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ একটি উদ্যান সংখ্যা প্রকাশ করে। তাতে অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর অমৃতবাবু একটি প্রবন্ধ লিখতে রাজি হন; তবে ছদ্মনামের শর্তে। বাগানের প্রথম সরকারি পরিচালিকা পারভিন এ হাশেম সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন না তিনি। অবশ্য আশঙ্কাটি অমূলক প্রমাণিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা গুরু-শিষ্য পর্যায়ে পৌঁছে। পারভিনের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে, টেলিফোন আলাপ আরো বেশি। বিটিভির জন্য তার একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম ‘সাইকি’র কনকসুধা কুঞ্জে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লতাটির বৈজ্ঞানিক নাম Odontaderia grandiflora (o. speciosa), গোত্র Apocynaceae, ক্রান্তীয় দক্ষিণ আমেরিকা ও ওয়েষ্ট ইন্ডিজের প্রজাতি। এটি আমদানির সময় হারিয়ে যায়। অক্লান্ত চেষ্টার পর নরেন্দ্রবাবু তা উদ্ধার করেন অষ্ট্রেলিয়ার এক বন্দর থেকে। অমৃতবাবুর এই প্রিয় লতাটির বাংলা নামকরণ করেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের আমার প্রিয় ছাত্র এবং অমৃতবাবুর শেষ জীবনের বন্ধু অধ্যাপক সানাউল্লাহ। একবার মস্কো থেকে ফিরে বলধাবাগানে গেলে পারভিন আমাকে শঙ্খনদ পুকুরে নতুন লাগানো ভিক্টোরিয়া অ্যামাজনিকা ও নানা রঙের শাপলা দেখাতে নিয়ে যান। সেখানে আমাদের জাতীয় ফুল সাদা শাপলা না দেখে কারণটি জানতে চাইলে পারভিন অবাক হন। তিনি বলেন, অনেকটিই ছিল। আমি জানতাম তেলাপিয়া মাছ লাল শাপলা বা রক্তকুমুদ ছাড়া অন্য শাপলার যম। তথ্যটি দিয়েছিলেন মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও আরেক প্রকৃতিপ্রেমী ডা. বিষষ্ণুপদ পতি। পারভিনকে সে কথা জানাই। তিনি পুকুর সেচে তেলাপিয়া তাড়িয়ে আবারো শাপলা লাগান। এতটাই উদ্যোগী ছিলেন এই প্রকৃতিপ্রেমী নারী। পরেরবার মস্কো থেকে ফিরে বাগান নিয়ে পারভিনের খোঁজ করলে শুনি তিনি বেঁচে নেই। বড় অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে গেলেন। বড় একটা ক্ষতি হলো বলধাবাগানের এবং সব উদ্যানী ও প্রকৃতিপ্রেমীর। বরিশালের নিসর্গী চক্ষু চিকিৎসক ডা. এম আহমেদ ছিলেন বলধাবাগান ও অমৃতবাবুর এক অকৃত্রিম একনিষ্ঠ বান্ধব। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও বলধাবাগানে আসতেন, অমৃতবাবুর সঙ্গে গল্প করতেন। এম আহমেদ আমাদের দেশে অনেক দিন পর পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে ভিক্টোরিয়া অ্যামাজনিকা (আমাজন লিলি) চাষে সফল হন এবং বলধাকে কয়েকটি চারা উপহার দেন। বলধার নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুক (Nymphaea capenbis) প্রজাতিটিও তারই দেওয়া। অমৃতবাবুর একটি স্বপ্ন ছিল, ডা. এম আহমেদের সঙ্গে আমাজন লিলির পাশে দাঁড়িয়ে একটি ফটো তোলা, যা আর পূরণ হয়নি। দু’জনেই প্রয়াত হন খুব কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে- যথাক্রমে ১৯৮২ সালের ২২ ডিসেম্বর ও ১৯৮৩ সালের ৪ জানুয়ারি।
ভারত উপমহাদেশে পার্ক বা বৃহদায়তন উদ্যান নির্মাণের কৃতিত্ব মোগলদের। এ শিল্পরীতির আদিরূপের একটি বিশিষ্ট আর্কিটাইপ এ মোগল উদ্যান, যা রীতিবদ্ধ, জলাধারযুক্ত এবং ছায়া ও শীতলতা সম্পৃক্ত। এটিই ভারতের একমাত্র নিজস্ব উদ্যানশৈলী, যা পরে ইংরেজ আগমনে আর বিকশিত হয়নি। বঙ্গভূমিতে ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের উদ্যানগুলো ছিল শাসক দেশের উদ্যানশৈলীর ব্যর্থ অনুকৃতি। সম্ভবত একক ব্যতিত্রক্রম এ বলধাবাগান, যা পুরাকীর্তির মর্যাদার দাবিদার। সে জন্য নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী পূজ্যপাদ। সাইকি শতবর্ষী, রীতিমুক্ত, অল্প জায়গায় অধিকসংখ্যক লতাগুল্ম প্রজাতির সুদৃশ্য বিন্যাসের এক দুর্লভ নজির। সত্তর বছরে সিবলী রীতিবদ্ধ, মাঝখানে চৌকো পুকুর, বৃক্ষপ্রধান। দুটি উদ্যানশৈলীই নির্মাতার উদ্ভাবন। অবশ্যই মৌলিক; যদিও এই অর্থে উপেক্ষিত যে, পরবর্তীকালের উদ্যানে এগুলোর কোনটিরই গড়ন আর অনুসৃত হয়নি। আমি যৌবনকাল থেকেই এ উদ্যান দুটি দেখে আসছি। তাই আমার চোখে এগুলোর ক্ষয় ধরা পড়ে। একালের বৈজ্ঞানিক প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আমাদের অনিচ্ছাকৃত অবহেলা- সবই এই অবক্ষয়ের হেতু হতে পারে। আমার জানা মতে, সাইকির দুটি মূল্যবান বৃক্ষ বাওবাব ও নাগকেশর (Ochrocarpus longifolius) আর নেই। শিবলীর কনকচাঁপা (Ochna squasrosa) গাছটিও ইদানীং মারা গেছে। এক সময় এখানে প্রচুর নীল, সাদা ও কাঁটা মিন্টি দেখেছি। এখন দেখি না। এবার তালগোত্রের দুর্লভ প্রজাতি Corypha elata গাছে ফুল ফুটেছে, যা তার মৃত্যুঘণ্টার আলামত। বলধাবাগান আমাদের জাতীয় বোটানিক উদ্যানের বেস গার্ডেন; অথচ গাছগুলোর নাম ও বানানের ভুলের পীড়াদায়ক ছড়াছড়ি। এ বাগান ঘিরে এখন বহুতল ভবন উঠছে। তাতে এলাকায় একটি মাইক্রোক্লাইমেট সৃষ্টি হতে পারে, যা হবে গাছগাছালির জন্য ক্ষতিকর। সিবলীতে ইদানীং কিছু দৃষ্টিকটু লিলি ফুল তৈরি হয়েছে। আমরা উদ্যান ও পার্কে ইটের কাঠামো নির্মাণকালে পরিবেশের সঙ্গে সেগুলোর মিলঝিলের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিই না, যা বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। এসব সত্ত্বেও আমাদের নতুন প্রজন্ম আজ অনেক বেশি পরিবেশ সচেতন। তারা এ অমূল্য ঐতিহ্যটি রক্ষা করবেন, বলধাবাগানের সমৃদ্ধি ঘটাবেন- এটিই প্রত্যাশা।

শতবর্ষে বলধা গার্ডেন

বলধা গার্ডেন শত বৎসর অতিক্রম করছে। এ বিষয়ে আজকের প্রথম আলো পত্রিকায় একটি তথ্যবহুল নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিবন্ধটি এখানে পুন:প্রকাশ করলাম।

গাছপাগল এক জমিদারের সারা জীবনের ভালোবাসার ফসল বলধা গার্ডেন। ইতিমধ্যেই আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে এই বাগান। শতবর্ষে পা দেওয়া এই বাগানের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন মোকারম হোসেন

১৯০৯ সাল। নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গের নতুন রাজধানী ঢাকা। বিচিত্র গাছপালায় সুশোভিত করতে হবে ঢাকার পথঘাট, উন্নুক্ত প্রাঙ্গণ। এই গুরুদায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় এসেছেন লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের অন্যতম কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলক। ঠিক একই সময় তৎকালীন ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে একটা বিশাল বাগান গড়ে তোলার কাজ শুরু করলেন এক প্রকৃতিপ্রেমী জমিদার। প্রায় ২৭ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৩৬ সালে শেষ হয় সেই বাগানের কাজ। প্রেমের দেবতা কিউপিডের পরমাসুন্দরী স্ত্রীর নামে বাগানের নাম রাখলেন তিনি সাইকি।
দেশি-বিদেশি অসংখ্য দুষ্কপ্রাপ্য গাছের এক ঈর্ষণীয় সমাবেশ এই বাগান। তখনকার অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কথা ভাবলে তাঁর এই প্রচেষ্টাকে অসাধ্য সাধন বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি না ছিলেন স্থপতি, না উদ্ভিদবিজ্ঞানী। উদ্যান রচনা করতে গিয়ে তাঁকে এসব নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। পছন্দসই গাছপালার তালিকা করে সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হয়েছে, কাঙ্ক্ষিত জিনিসটির জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে দিনের পর দিন। তারপর যথাস্থানে রোপণের পর পরিচর্যা, বাঁচানোর চেষ্টা, ফুল ফোটার পর আত্মতুষ্টি, কোনো কোনো ভিনদেশি প্রজাতির কষ্টসাধ্য অভিষেক−এসব নিয়েই দারুণ ব্যস্ত সময় কাটত তাঁর। কিউপিডের মতোই অক্লান্ত চেষ্টায় সাইকিতে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন তিনি।
সাইকির লে-আউট প্ল্যান ছিল প্রকৃতিমনা জমিদারের শৈল্পিক মনের এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশ। গ্রিন হাউসের দরজার বাইরে থেকে মনে হয় যেন একটা জলসাঘর, যেখানে রয়েছে সাজানো মঞ্চ, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে আছেন শিল্পীরা। প্রবেশপথের দুই পাশে শাপলা-পদ্মের পুকুর।
এতক্ষণ প্রকৃতপ্রেমী যে মানুষটার কথা বললাম, তাঁর নাম নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী, বলধার শেষ জমিদার। গাজীপুরের ছায়াঢাকা পাখিডাকা ছোট্ট এক গ্রাম বলধা। এখানেই নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর বাড়ি। আজ সেখানে কিছুই নেই, আছে ধ্বংসাবশেষ। ঢাকার ওয়ারিতেও ‘কালচার’ (বলধা হাউস) নামে তাঁর আরেকটি বাড়ি ছিল। বলধা গ্রামে তাঁর ৪০ কামরার বিশাল বাড়ি থাকলেও এই বলধা হাউসেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে গেছেন তিনি।

তবুও আশা অফুরাণ
শুধু সাইকির বৃক্ষবৈচিত্র্যে তুষ্ট হতে পারলেন না নরেন্দ্রনারায়ণ, নিঃসঙ্গ সাইকির যথার্থ সঙ্গী চাই। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ১৯৩৮ সালে নবাব রোডের উত্তর পাশে শুরু করেন আরেকটি বাগান তৈরির কাজ। লালমোহন সাহাদের কাছ থেকে জায়গাটা কিনে নেন নারায়ণ রায়। এটা ছিল সাহাদের বাগানবাড়ি। পুকুর আর সুর্যঘড়ি ছাড়া তখন এখানে কোনো স্থাপনা ছিল না। আর ছিল দুটি গাছ: একটি বাদাম, অন্যটি খেজুর।
সারা বিশ্বে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা। কিন্তু কাজ থামিয়ে রাখেননি তিনি। দেশ-বিদেশ থেকে আসতে থাকে গাছপালা লতাগুল্ম। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে যথার্থ সহকর্মীর মতো তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান এক যুবক, অমৃতলাল আচার্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলধার সুখ-দুঃখে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন এই আপনভোলা প্রকৃতিপ্রেমী। বাবার প্রেরণায়ই তিনি মূলত বাগানের কাজে আকৃষ্ট হন। বাবা অখিলচন্দ্র চক্রবর্তী লন্ডনের কিউ উদ্যানের অন্যতম কর্মী, শ্যামলী রমনার নিসর্গ নির্মাণে প্রাউডলকের সহকর্মী।
’৩৯ সালে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে, ঘাটের ঠিক ওপরে নারায়ণ রায় নির্মাণ করেন বাগানের এক নিভৃত কক্ষ, ‘জয় হাউস’। বৈঠকখানা ও বিশ্রামাগার হিসেবেই এই কক্ষ ব্যবহূত হতো। এ বাগানে প্রথম লাগানো গাছ চাঁপা। রোপণের জন্য চারাটি তিনি অমৃতবাবুর হাতে তুলে দেন। ধীরে ধীরে এ বাগানে লাগানো হয় নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি গাছগাছড়া। প্রথম থেকেই এখানে শুরু হয় নানা ধরনের প্রায়োগিক গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রজনন ও প্রসারণ।
বাগানের বহুমুখী ব্যয়ের ক্ষেত্রেও জমিদার ছিলেন মুক্তহস্ত। দেশ-বিদেশ থেকে শুধু গাছপালা, কলম ও বীজই আনাতেন না, সেগুলোর যত্ন-আত্তি ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও সংগ্রহ করতেন। মূল্যবান গাছের পাতার ধুলোবালি পরিষ্ককারের জন্য সে সময় টিস্যু পেপার ব্যবহূত হতো। এভাবেই নারায়ণ রায়ের স্নেহমাখা, সৃজনশীল ও স্বতঃস্কুর্ত পরিবেশে ১৯৪০ সালে শেষ হয় বাগানের কাজ। গ্রিক উর্বরতার দেবীর নামে বাগানের নাম রাখলেন ‘সিবিলি’। জমিদার পরিতৃপ্তির আনন্দে বিভোর। কিন্তু এই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না, আততায়ীদের হাতে নিজের একমাত্র পুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণ রায় খুন হলে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েন। তিন বছরের ব্যবধানে ’৪৩ সালের ১৩ আগস্ট তিনিও মারা যান। সিবিলিতে পুত্রের পাশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
বলধা গার্ডেন নারায়ণ রায়ের দেওয়া নাম নয়। সাইকি ও সিবিলিকে জোড়া দিয়ে সবাই তাঁর জমিদারির নামানুসারে বলধা গার্ডেন বলা শুরু করেন। বাগানের সর্বমোট আয়তন দশমিক এক হেক্টর হলেও সাইকি অংশ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যথাক্রমে ১০০ ও ৪৫ মিটার। সিবিলি অংশ সর্বসাধারণের জন্য উন্নুক্ত হলেও সাইকি সংরক্ষিত। ধারণা করা হয় যে নারায়ণ রায় সাইকি অংশ দিয়েই বাগানে প্রবেশ করতেন। বাসস্থান বলধা হাউস ও সাইকি আলাদা করেছিলেন অনুপম গ্রিন হাউস বা ছায়াবীথি তৈরি করে। সেই গ্রিন হাউসের ভেতর তিনি মাটি ও পাথর দিয়ে বানিয়েছিলেন কৃত্রিম পাহাড় ও সুড়ঙ্গ।

বাগানের ক্রান্তিকাল
জমিদারের মৃত্যুর পরপরই স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে বলধার প্রাণপ্রদীপ। শুধু অর্থানুকুল্য নয়, তাঁর স্নেহমাখা পরিচর্যা থেকেও বঞ্চিত হয় বাগানের গাছপালা। নানা অসুবিধা সত্ত্বেও বাগানকর্মীরা হাল ছাড়েন না। কেবল প্রাণে বেঁচে থাকে অসংখ্য গাছপালা, আর এর প্রায় পুরো কৃতিত্বই অমৃতলাল আচার্যের। ’৪৭ সালে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হলেও নিভৃতেই থেকে যায় বলধা গার্ডেন। ’৫১ সালে বলধা বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় কোর্ট অব ওয়ার্ডের ওপর। এ সময় অমৃতবাবু ও তাঁর সহকর্মীরা খেয়ে না খেয়ে, বিনা বেতনে, অর্ধবেতনে কোনো মতো প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেন বাগানকে। তবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়ে প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে বাগান। ’৬২ সালের দিকে বলধা গার্ডেন বন বিভাগের অধীনে ন্যস্ত হলে সাময়িকভাবে অবস্থার পরিবর্তন হয়, এ সময় অমৃতবাবুকে বন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই আবার সরকারি নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায় বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ। স্বাধীনতার পর কিছুদিন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হিসেবে বলধা বাগানের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবউদ্দীন চৌধুরী। আন্তরিকভাবেই তিনি বাগানের উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করেন। বাংলার বিচিত্র প্রকৃতি গ্রন্েথ তিনি জানিয়েছেন, ‘খরার মৌসুমে শঙ্খনদ পুকুরকে পানি দিয়ে ভরিয়ে রাখা ও বাগানের গাছপালার জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করাই হয়ে উঠল আমাদের প্রথম ও প্রধান উন্নয়ন প্রচেষ্টা। টাকার প্রয়োজন। বন বিভাগের বাজেট থেকে যে টাকা পাওয়া যায়, সেটা অপ্রতুল।’ অবশেষে তিনি কিছু অর্থ সংগ্রহে সমর্থ হন এবং তা দিয়েই বাগান সংস্কারের কাজ শুরু করেন।

কিছু প্রস্তাব
বলধা গার্ডেন আজ বিপন্ন। এ বাগানের শুধু উত্তর পাশটা উন্নুক্ত, বাকি তিন পাশ ঘিরে রেখেছে সুউচ্চ দালানকোঠা। ফলে সারা বছরই রোদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার দুর্লভ উদ্ভিদ প্রজাতি। প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসের অভাবে ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে কয়েক প্রজাতির গাছ। হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও অনেক প্রজাতি। অতিরিক্ত ছায়ায় বিবর্ণ হয়ে পড়েছে সাইকির দক্ষিণাংশের গাছপালা। উঁচু ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র করে পরিবেশবাদীরা ব্যাপক লেখালেখি ও আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা এই বাগানকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন দুঃসময়েও হারিয়ে গেছে কিছু সংগ্রহ। জমিদারের অকাল মৃত্যুতে কিছু সংগ্রহের সঠিক উপাত্তও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব হারিয়ে যেতে পারে বলেও কেউ কেউ ধারণা করেন। ইদানীং কিছু কিছু গাছ শনাক্তের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কখনোই পর্যাপ্ত বাজেট থাকে না। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও বন্ধ থাকে। জমিদারের আমলে যেখানে মালির সংখ্যা ছিল ৪০, বর্তমানে তা কমে দাঁড়িছে পাঁচজনে।
অনেক নিসর্গীই মনে করেন, অন্যত্র এর আদলে হুবহু আরেকটি বাগান তৈরি করে সেখানে একই পদ্ধতিতে গাছপালা রোপণ করা দরকার। এর জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে ঢাকার অদুরে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান বা সংলগ্ন এলাকা। বলধা বাগানের সমপরিমাণ জায়গা নিয়ে বিদ্যমান নকশায় গ্রিড ধরে ধরে সেই বাগানের প্রতিটি উদ্ভিদের চারা একটি করে রোপণ করে সৃষ্টি করা যায় নতুন বলধা গার্ডেন। এর জন্য আগে থেকেই বানাতে হবে বিশেষ বীজতলা। বীজ আসবে বাগান থেকে। ইতিমধ্যে যেসব গাছ হারিয়ে গেছে তা আবার সংগ্রহ করতে হবে, যেসব গাছ বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সেসবও। আর এসব কাজে আমাদের পাশে থাকতে পারে ইউনেস্কো। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোনোভাবেই যেন উদ্যানের পুরোনো নকশার বিকৃতি না ঘটে, অবহেলার শিকার না হয় আদি উদ্যান।

Thursday, May 29, 2008

জাতীয় বৃক্ষ

আজকের বিডিনিউজ ২৪ এ দেখলাম নজরুল সেনাদল ও নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদ বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে কৃষ্ণচুড়ার নাম প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাবের স্বপক্ষে ঠিক কি কি যুক্তি তারা বলেছে তা খবরে বিস্তারিত নেই। তারা বারবার কৃষ্ণচূড়াকে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ বলেছে। আমি তাদের বক্তব্য ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার জানামতে কৃষ্ণচূড়া একটি বিদেশী গাছ। কতদিন আগে এদেশে এসেছে তা বলতে পারব না। তবে এই গাছ এসেছে মাদাগাস্কার থেকে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে এর সৌন্দর্যের জন্য। মৌসুমে যখন গাছভর্তি লাল ফুল ফোটে তখন তার সৌন্দর্য সত্যিই অনুপম হয়ে ওঠে। চারপাশের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে গাছটি পরিবেশ বান্ধব। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই গাছে পাখিরা কম বসে। পাখিরা বাসা বানায় না। এর ফল পাখিদের খাদ্য নয়। তাহলে কিভাবে এই গাছকে পরিবেশ বান্ধব বলা যায় তা ঠিক বোধগম্য হল না। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে যদি কোন গাছকে নির্বাচন করতে হয় তাহলে আমি মনে করি বটগাছকে এই সম্মানটা দেয়া উচিত। বটগাছ আমাদের প্রকৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতিতে যত জায়গা জুড়ে আছে তার বিপরীতে আমাদের প্রতিদান একটুও নেই। বরং আমরা পরিবারের অভিভাবকের মত বটবৃক্ষকে ইটের ভাটায় অবলীলায় বিসর্জন দিয়েছি। আমাদের লোভ বয়সী অভিভাবকের হত্যালীলায় বাধা দেয় নি। অথচ বটগাছ পথিককে ছায়া দিয়ে, পাখিকে আশ্রয় দিয়ে, বিভিন্ন প্রাণীকে কোলে বাসা বানাতে দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। দেশী সব পাখিরা বটের ফল খেতে দারুণ পছন্দ করে। সকলে এর ডালে, পাতার ফাঁকে বাসা বানায়। বটবৃক্ষের শরীরের খোড়লে পেঁচা, সাপ প্রভৃতির বাসা অবলীলায় স্থান পায়। এখন হয়ত বটগাছকে ততটা দেখা যায় না। তার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন বিদেশী গাছ। যদি বিদেশী কোন গাছকে জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে তাহলে ইউক্যালিপটাসকেই বরং তা দেয়া উচিত। এই পরিবেশ বিধ্বংসী গাছটিকে আমরা যতটা ভালবাসি, দেশের আনাচে কানাচে তথা জমির আল, আলাদা জমি, বাড়ির কোণ/ উঠান, পুকুরের পাড় ইত্যাদি জায়গায় যেভাবে স্থান দিয়েছি তাতে তাকে জাতীয় বৃক্ষ না বলেই বা উপায় কি? আমি নজরুল সেনা বা নেত্রকোনা সাহিত্য পরিষদকে অসম্মান করতে চাচ্ছি না। তাদের যুক্তি হয়ত আরও শাণিত হতে পারে, যা খবরে বিস্তারিত আসে নি। তবে জাতীয় বৃক্ষ বলতে কোন গাছকে ঘোষণা করার আগে তা অবশ্যই উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ এবং বিশেষ করে দ্বিজেন শর্মার মতামত নিয়েই করা উচিত। আজ প্রকৃতিপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মার ৮০তম জন্মদিন গেল। এই সুযোগে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও ভালবাসা জানাচ্ছি।

Saturday, May 24, 2008

সুগার পাম গাছের মৃত্যু

বাংলাদেশের অন্যতম একটি বাগান হল বলধা গার্ডেন। ১৯০৯ সালে প্রকৃতিপ্রেমিক জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী সাইকি ও সিবেলি নামে দুইভাগে ভাগ করে এই বাগানটি তৈরি করেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিরল প্রজাতির গাছ এনে তাঁর বাগানটি সাজিয়েছিলেন। বর্তমানে সেখানে ৮৭ পরিবারভুক্ত ৩৩৯ বর্গের ৬৭২ প্রজাতির ১৫ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে।

১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে কোন এক সময় তিনি সেখানে একটি সুগার পাম গাছ লাগিয়েছিলেন। এই গাছ শতবর্ষী। বেচে থাকে ১০০ বৎসর। জীবনকালের মধ্যে মাত্র একবার ফুল ফুটিয়ে বংশবিস্তার করে এই গাছ মারা যায়। জমিদারের নিজ হাতের এই গাছটি ইদানীং ফুল ফুটিয়েছে। তার মানে কিছুদিনের মধ্যেই গাছটি মারা যাবে। পরবর্তী বংশকে জায়গা করে দেবার জন্যই এই ত্যাগ। তবে অতটা দু:খ পাবার কিছু নেই। কারণ ফুল ফোটানোর অর্থই হল তার বংশবিস্তার হবে। এতদিন বাংলাদেশের আর কোথাও এই গাছ না থাকলেও এখন হবে। গাছ থেকে প্রাপ্ত ফল থেকে চারা তৈরি করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হয়ত ছড়িয়ে দেয়া হবে।

ছবি ও তথ্য কৃতজ্ঞতা: নেচার অফ বাংলাদেশ

Saturday, May 17, 2008

পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে

গত ১০ ও ১১ মে তারিখে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত হলএরই প্রেক্ষিতে (সম্ভবত) ১৩ মে বাংলাদেশ নেচার কনজারভেশন কমিটি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলএই সভায় বেশ কিছু আশংকাজনক তথ্য উপস্থাপিত হয়েছেতারা বলেছেন ৩০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১০০ প্রজাতির মত পাখি এখন আর বাংলাদেশে আসছে নাতারা অন্য কোন দেশে চলে যাচ্ছেএতে অবশ্য পাখিদের কোন দোষ নেইতারা যেখানে নিরাপত্তা পাবে সেখানেই যাবেএন সি সি আরও বলেছে দেশীয় প্রজাতির প্রায় ১০ প্রজাতির পাখি গত ২০ বছরে বিলুপ্ত হয়ে গেছেকি মর্মান্তিক ঘটনা!

এনসিসি'র মতে পরিযায়ী পাখির মধ্যে ডানলিন, রাডি টার্নস্টোন, টেরেক সেন্ডপাইপার, গ্রেটেল্ড কাটলার, মার্সসেন্ড পাইপার, স্পোনবিল সেন্ডপাইপার, গ্রেটার ইয়োলো লেগ, স্পটেড রেডসেঙ্ক প্রভৃতি পরিযায়ী পাখি এখন আর বাংলাদেশে আসে না

বাংলাদেশের নিজস্ব প্রজাতির পাখির মধ্যে বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান, ভারতীয় ময়ূর, গ্রেটহর্ন বিল, গ্রেটহর্ন আউল, আলেকজান্দ্রা প্যারাকিট, কোরাল, ওয়াটার কক, বাদি হাঁস বিলুপ্ত প্রজাতির খাতায় নাম লিখিয়েছেঅনেক আগে গোলাপী হাঁস নামে এক প্রজাতির হাঁস জাতীয় পাখি বাংলাদেশে ছিলসেটাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে

এনসিসি-এর প্রধান সাজাহান সরদার এর মতে ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পাখিশুমারী শুরু হয়আর বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পাখি গণনা শুরু হয় ২০০২ সালেপ্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে গত বিশ বৎসরে এদেশের নিজস্ব প্রজাতির ৫০ রকমের পাখি বিলুপ্তি পর্যায়ে গেছেআর পরিযায়ী পাখির বৈচিত্র্য কমে গেছেআগে আসত ৩০০ প্রজাতির, আর এখন আসে ২০০ প্রজাতির১০০ প্রজাতির পাখি অন্য দেশকে নিজেদের পরিযায়ন এলাকা হিসেবে পছন্দ করেছেবিডিনিউজ২৪ এ প্রকাশিত কিছু তথ্য সরাসরি তুলে দিচ্ছি

পাখি বিশেষজ্ঞ ড. আলী রেজা খানের মতে, ইউরেশিয়ায় ৩শ' প্রজাতির বেশি প্রজননকারী পাখির এক তৃতীয়াংশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বা আফ্রিকায় পরিযান করেএসব পাখির এক তৃতীয়াংশ আসে বাংলাদেশেএখানে সাইবেরিয়া থেকে কম সংখ্যক পাখি আসে, বেশিরভাগই আসে হিমালয় ও উত্তর এশিয়া থেকে

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্টের (WTB) পরিচালক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, "পরিযায়ী-স্থানীয় পাখি একটি এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও খাদ্য পরিস্থিতির নিদের্শক হিসাবে কাজ করেএদের আনাগোনা কমে যাওয়া মানে তাদের আবাস ও খাদ্য ঘাটতির লক্ষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠাএসব পাখি যাত্রা পথে খাবার ও বিরতির জন্যে দীর্ঘদিন নির্দিষ্ট পথে চলাচল করেখাবারের সঙ্কট হলে অন্যত্র গমন করে।"

স্থানীয় ১০ প্রজাতির পাখি পুরোপুরি বিলুপ্তির আশঙ্কা প্রকাশ করে সাজাহান সরদার জানান, গত ২০ বছরে শ'খানেক প্রজাতির বেশি পাখি রেকর্ড করা সম্ভব হয়নিদেশের জন্য এটি একটি চরম বিপদ সংকেত

আসলে আমাদের দরিদ্রতাই আমাদের চরম শত্রুপেটে খিদে থাকলে কোন সচেতনতাই আর কাজ করে নামানুষ যেখানে কষ্ট পায় সেখানে পাখিদের কষ্ট না হয়ে উপায় কি আর আছে?

Wednesday, May 14, 2008

প্রকৃতিতে আগুন

প্রকৃতিতে আগুনের ছোঁয়া স্পষ্ট অনুভব হচ্ছে। এখন বসন্ত কাল নয়। তারপরও গাছে গাছে যেভাবে ফুলে ভরে আছে তা দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এটা কি রাধাচূড়া নাকি কৃষ্ণচূড়া। আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নই। প্রচলিত সামাজিক নিয়ম মত গাছেদের সাথেও আমার সম্পর্ক ততটা ঘনিষ্ঠ নয়। তাই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না যে এটা কৃষ্ণচূড়া নাকি রাধাচূড়া। অবশ্য জানি যেটা একটু হালকা রঙ সেটা রাধাচূড়া। মাদাগাস্কার থেকে আসা এই গাছটি আমাদের প্রকৃতিতে অপার সৌন্দর্য যোগ করেছে ঠিকই। কিন্তু এটা কতটা বাংলাদেশের পরিবেশ বান্ধব তা অবশ্যই ভাবনার অবকাশ রাখে। কারণ এই গাছে কোন পাখি বাসা বাধে না। পাখিরা বসেও কম। তা এটা অবশ্য অন্য কথা। সেটার প্রসঙ্গও ভিন্ন। সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের গাছদুটো যেভাবে ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে, তাতে থমকে না দাঁড়িয়ে পারলাম না।

প্রকৃতিতে আনন্দ

প্রকৃতির মনে আনন্দের ছোঁয়া লেগেছে। জারুল ফুলের বন্যা নেমেছে চারপাশে। আমাদের কুড়িগ্রাম শহরে অনেকগুলো জারুল গাছ রয়েছে। পোস্ট অফিসের সামনে, বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার পথে, ডিসি অফিসের ভিতরে এবং চারপাশে অনেকগুলো জারুল গাছ চোখে পড়ল। এতদিন সেভাবে দেখিনি। কিন্তু এই মৌসুমে যেভাবে সবগুলো গাছ ফুলে ফুলে নিজেকে সাজিয়েছে তাতে তো চোখ ফেরানো কঠিন।

Sunday, May 11, 2008

চিলের বিষ্ঠা


কুড়িগ্রাম শহরে সম্ভবত ৪০টির বেশি চিলের বাস। আমি পাখি বিশেষজ্ঞ নই। পাখি সম্পর্কে কোন প্রশিক্ষণ নেই। তাই ঠিকমত হয়ত তাদের সংখ্যা গুনতে পারিনি। তবে আরও কয়েকজনের মুখে সংখ্যাটির সপক্ষে সমর্থন পেয়েছি।

কুড়িগ্রামে নতুন বাজারের মোড়ে ফায়ার সার্ভিস এর অফিস। এই অফিসের ঠিক দক্ষিণ পাশে বড় বড় কয়েকটা ইউক্যালিপটাস গাছ আছে। এ বিষয়ে আমার পূর্ববর্তী একটি পোস্ট আছে এখানে। এই গাছে ২০টির বেশি চিল রাত্রিযাপন করে। সন্ধ্যার আগে আগে আসে। গাছের মাথার উপরে পাক খেয়ে ঘুরে ঘুরে উড়ে এসে মগডালে আশ্রয় নেয়। ততক্ষণে চারপাশে সন্ধ্যা নেমে আসে। অন্ধকার আলোকে আড়াল করে ফেলে। ভালমত সব কিছু চোখে পড়ে না। আবার ভোর হতে না হতেই চিলেরা খাদ্যের সন্ধানে চলে যায় দৃষ্টিসীমার বাহিরে, অনেক দূরে। কিন্তু নীচের রাস্তায় তার ছাপ থেকে যায়। সারারাত্রি তাদের মলত্যাগের চিহ্ন রাস্তায় স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ে।

Saturday, May 10, 2008

বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস

আজ এবং আগামীকাল বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস (World Migratory Bird Day) পালিত হচ্ছে পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলকে নিরাপদ রাখা ও পাখিদের বিচরণস্থল সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে এই দিবসে। পরিযায়ী পাখিদের সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৬ সাল থেকে এই দিবস পালন শুরু করা হয়। প্রত্যেক বৎসর ১০ ও ১১ মে তারিখে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এই দিবসকে পালন করা হয়। এবারের দিবসের শ্লোগান হল "পরিযায়ী পাখি: জীব বৈচিত্রের দূত"। বর্তমান বিশ্বের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পাখিদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একারণে পরিযায়ী পাখিরা মারাত্মক খাদ্য সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই অবস্থা দূরীকরণই এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য।

পরিযায়ী পাখিদেরকে আগে অতিথি পাখি বলা হত। কিন্তু নিবিড় গবেষণায় দেখা গেছে যে এরা অতিথি নয়। বরং যে দেশে যায় সেখানে তারা ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত বাস করে। অর্থাৎ বৎসরের বেশ কয়েকমাস তারা ভিনদেশে বাস করে। বরং তারা নিজ দেশে বাস করে স্বল্প সময়ের জন্য। এই সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি হওয়া দরকার। বাংলাদেশে এখনও মানুষের মধ্যে সেভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হয় নাই বলে এখনও পরিযায়ী পাখিদেরকে সুস্বাদু খাদ্যের উৎস বলে মনে করা হয়। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক।

বিপন্ন উল্লুক

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছেআজকের একটা খবর হল "বাংলাদেশে উল্লুকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে"খবরে বলা হয়েছে:-

দেশের ১০ প্রজাতির বানরের মধ্যে ৮টিই কোনো না কোনোভাবে হুমকির সম্মুখীনএদের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন উল্লুকআকার, আকৃতি ও আচরণের কারণে সহজে দৃষ্টি কাড়ে গোরিলা কিংবা শিম্পাঞ্জির মতো দেখতে লেজহীন এই উল্লুকতবে আশঙ্কার বিষয়- উপযুক্ত আশ্রয় ও খাদ্যাভাবে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রজাতির তালিকায় থাকা উল্লুকের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছেগত দুই দশকে এর সংখ্যা তিন হাজার থেকে কমে নেমে এসেছে ৩০০-এ

খবরটা পড়ে খারাপ লাগলআমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী বন্যপ্রাণীর সাথে আমাদের সম্পর্ক শুধুই শত্রুতারযে কোন বন্যপ্রাণী আমাদের চোখে পড়লে আমাদের প্রথম চিন্তা থাকে তাকে কিভাবে হত্যা করা যায়প্রাণীরাও এটা জানেতারাও আমাদেরকে এড়িয়ে চলেতারা জানে আমাদের মধ্যে মানবিকতার পরিমাণ খুব কম তারই ধারাবাহিক ফল এই উল্লুকের সংখ্যা কমে যাওয়াশুধু যে আমাদের অন্তর্গত হিংস্রতা এর জন্য দায়ী তা নয়আমাদের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অজ্ঞতা ইত্যাদির কারণেও বন্যপ্রাণীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছেপরিবেশের ক্ষতি, উপকারী ও দেশীয় গাছ কেটে ফেলা ইত্যাদি কারণে বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক বিচরণ ক্ষেত্র ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেছেআর তার প্রভাব পড়ছে বন্যপ্রাণীদের জীবনে

উল্লুক সারাবিশ্বেই বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় নাম লিখিয়েছে অনেক আগেইআমরা তাদেরকে রক্ষা করতে পারতামকিন্তু সেই সুযোগ আমরা গ্রহণ করিনিখবরে দেয়া তথ্য অনুযায়ী " বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্ট (ডব্লিউটিবি)- এর নির্বাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককমকে জানান, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের উল্লুকের সংখ্যা তিন হাজার থেকে কমে ৩০০-এ নেমে এসেছে" খবরে আরও একটি বিশেষ তথ্য রয়েছে। "ডব্লিউটিবি এর তথ্যমতে, বাংলাদেশেরর উত্তর-পূর্ব (বৃহত্তর সিলেট) ও দক্ষিণ-পূর্ব (চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম) এলাকার বন ছাড়াও ভারত (উত্তর-পূর্বাংশ), মিয়ানমার (পশ্চিমাংশ) এবং চীনে উল্লুক দেখা যায়উল্লুক প্রাইমেট গ্রুপের একটি হলো লেজার এপ, অন্যটি গ্রেটার এপআর এই গ্রেটার এপ-এর আওতায় রয়েছে শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং ওটাং"

উল্লুকের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বনাঞ্চল ধ্বংসবাংলাদেশে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান উল্লুকের প্রধান আবাসস্থলএছাড়াও সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় উল্লুক বাস করেবনাঞ্চল ধ্বংসের সাথে উল্লুকের বাসস্থান ও খাদ্যর উৎস নষ্ট হয়ে যাচ্ছেআমাদের অতিদ্রুত সচেতন না হলে এই সুন্দর প্রাণিটিকে দেশ থেকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না

ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

জীবন থেমে থাকে না


যাবতীয় সীমাবদ্ধতার মাঝেও জীবনের বিকাশ ঘটে। প্রতিকূল পরিবেশের প্রতিরোধ করেই জীবন এগিয়ে যেতে চায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন পৃথিবীর সন্ধানে। কেউ সফল হয় কেউ বা হয় না। এই যেমন এই ছোট্ট গাছটি। কংক্রিটের এক কঠিন ভিত্তিতে গেড়েছে স্বপ্নের শিকড়। বেঁচে থাকবার দুরূহ প্রচেষ্টায় নিয়ত সংগ্রাম তার। কিন্তু সাফল্য কি সে পাবে? যে স্বপ্নীল ভবিষ্যতের জন্য তার জন্ম হয়েছে এই পৃথিবীতে তাকে কি সে বাস্তবায়ন করতে পারবে? হয়ত পারবে, হয়ত পারবে না। তবুও জীবনের জন্য লড়াই করতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় সমস্ত বাধাবিপত্তি ঠেলে দুহাতে সরিয়ে।

Thursday, May 1, 2008

পেপে গাছ

পেপে গাছের বিকাশ আসলেই অন্যরকম। জীবনের পর্যায়ে পর্যায়ে যে শিহরণ তা থেকে যেন সে অন্যরকম শিক্ষা নিয়ে থাকে।

শাপলার কোণে পাখির বাসা

শহরের জিরো পয়েন্ট শাপলা মোড়। পূর্বে এখানে রেলঘুন্টি ছিল। পরিবর্তিত শহর পরিকল্পনা কিংবা বাণিজ্যিক উপযোগীতা কোন একটির কথা চিন্তা করে রেল লাইন কুড়িগ্রাম শহর থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। মোড়ের পূর্ব কোণে আওয়ামী লীগ অফিস। এখন বিবর্ণ এবং নিরব। তার পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে ছোট একটি রাস্তা। পাশে স-মিল। এই কোণের একটি বিদ্যুতের খুঁটি পাখিটির কেন যে বাসা বানাবার জন্য পছন্দ হল তা বলা মুশকিল। কারণ জায়গাটা সারাদিন এবং রাতের অধিকাংশ সময় হৈ হট্টগোলে ভরা থাকে। হৈ চৈ চেচামেচি তথা যাবতীয় শব্দদূষণ জায়গাটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারপরও পাখিটির কাছে সুখের নীড় অসুখে পরিণত হয়নি।