Friday, May 30, 2008

শতবর্ষে বলধা গার্ডেন

বলধা গার্ডেন শত বৎসর অতিক্রম করছে। এ বিষয়ে আজকের প্রথম আলো পত্রিকায় একটি তথ্যবহুল নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিবন্ধটি এখানে পুন:প্রকাশ করলাম।

গাছপাগল এক জমিদারের সারা জীবনের ভালোবাসার ফসল বলধা গার্ডেন। ইতিমধ্যেই আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে এই বাগান। শতবর্ষে পা দেওয়া এই বাগানের আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন মোকারম হোসেন

১৯০৯ সাল। নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গের নতুন রাজধানী ঢাকা। বিচিত্র গাছপালায় সুশোভিত করতে হবে ঢাকার পথঘাট, উন্নুক্ত প্রাঙ্গণ। এই গুরুদায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় এসেছেন লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের অন্যতম কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলক। ঠিক একই সময় তৎকালীন ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে একটা বিশাল বাগান গড়ে তোলার কাজ শুরু করলেন এক প্রকৃতিপ্রেমী জমিদার। প্রায় ২৭ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৯৩৬ সালে শেষ হয় সেই বাগানের কাজ। প্রেমের দেবতা কিউপিডের পরমাসুন্দরী স্ত্রীর নামে বাগানের নাম রাখলেন তিনি সাইকি।
দেশি-বিদেশি অসংখ্য দুষ্কপ্রাপ্য গাছের এক ঈর্ষণীয় সমাবেশ এই বাগান। তখনকার অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কথা ভাবলে তাঁর এই প্রচেষ্টাকে অসাধ্য সাধন বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি না ছিলেন স্থপতি, না উদ্ভিদবিজ্ঞানী। উদ্যান রচনা করতে গিয়ে তাঁকে এসব নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছে। পছন্দসই গাছপালার তালিকা করে সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হয়েছে, কাঙ্ক্ষিত জিনিসটির জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে দিনের পর দিন। তারপর যথাস্থানে রোপণের পর পরিচর্যা, বাঁচানোর চেষ্টা, ফুল ফোটার পর আত্মতুষ্টি, কোনো কোনো ভিনদেশি প্রজাতির কষ্টসাধ্য অভিষেক−এসব নিয়েই দারুণ ব্যস্ত সময় কাটত তাঁর। কিউপিডের মতোই অক্লান্ত চেষ্টায় সাইকিতে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন তিনি।
সাইকির লে-আউট প্ল্যান ছিল প্রকৃতিমনা জমিদারের শৈল্পিক মনের এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশ। গ্রিন হাউসের দরজার বাইরে থেকে মনে হয় যেন একটা জলসাঘর, যেখানে রয়েছে সাজানো মঞ্চ, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে আছেন শিল্পীরা। প্রবেশপথের দুই পাশে শাপলা-পদ্মের পুকুর।
এতক্ষণ প্রকৃতপ্রেমী যে মানুষটার কথা বললাম, তাঁর নাম নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী, বলধার শেষ জমিদার। গাজীপুরের ছায়াঢাকা পাখিডাকা ছোট্ট এক গ্রাম বলধা। এখানেই নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরীর বাড়ি। আজ সেখানে কিছুই নেই, আছে ধ্বংসাবশেষ। ঢাকার ওয়ারিতেও ‘কালচার’ (বলধা হাউস) নামে তাঁর আরেকটি বাড়ি ছিল। বলধা গ্রামে তাঁর ৪০ কামরার বিশাল বাড়ি থাকলেও এই বলধা হাউসেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে গেছেন তিনি।

তবুও আশা অফুরাণ
শুধু সাইকির বৃক্ষবৈচিত্র্যে তুষ্ট হতে পারলেন না নরেন্দ্রনারায়ণ, নিঃসঙ্গ সাইকির যথার্থ সঙ্গী চাই। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ১৯৩৮ সালে নবাব রোডের উত্তর পাশে শুরু করেন আরেকটি বাগান তৈরির কাজ। লালমোহন সাহাদের কাছ থেকে জায়গাটা কিনে নেন নারায়ণ রায়। এটা ছিল সাহাদের বাগানবাড়ি। পুকুর আর সুর্যঘড়ি ছাড়া তখন এখানে কোনো স্থাপনা ছিল না। আর ছিল দুটি গাছ: একটি বাদাম, অন্যটি খেজুর।
সারা বিশ্বে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামা। কিন্তু কাজ থামিয়ে রাখেননি তিনি। দেশ-বিদেশ থেকে আসতে থাকে গাছপালা লতাগুল্ম। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে যথার্থ সহকর্মীর মতো তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান এক যুবক, অমৃতলাল আচার্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বলধার সুখ-দুঃখে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন এই আপনভোলা প্রকৃতিপ্রেমী। বাবার প্রেরণায়ই তিনি মূলত বাগানের কাজে আকৃষ্ট হন। বাবা অখিলচন্দ্র চক্রবর্তী লন্ডনের কিউ উদ্যানের অন্যতম কর্মী, শ্যামলী রমনার নিসর্গ নির্মাণে প্রাউডলকের সহকর্মী।
’৩৯ সালে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে, ঘাটের ঠিক ওপরে নারায়ণ রায় নির্মাণ করেন বাগানের এক নিভৃত কক্ষ, ‘জয় হাউস’। বৈঠকখানা ও বিশ্রামাগার হিসেবেই এই কক্ষ ব্যবহূত হতো। এ বাগানে প্রথম লাগানো গাছ চাঁপা। রোপণের জন্য চারাটি তিনি অমৃতবাবুর হাতে তুলে দেন। ধীরে ধীরে এ বাগানে লাগানো হয় নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি গাছগাছড়া। প্রথম থেকেই এখানে শুরু হয় নানা ধরনের প্রায়োগিক গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রজনন ও প্রসারণ।
বাগানের বহুমুখী ব্যয়ের ক্ষেত্রেও জমিদার ছিলেন মুক্তহস্ত। দেশ-বিদেশ থেকে শুধু গাছপালা, কলম ও বীজই আনাতেন না, সেগুলোর যত্ন-আত্তি ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও সংগ্রহ করতেন। মূল্যবান গাছের পাতার ধুলোবালি পরিষ্ককারের জন্য সে সময় টিস্যু পেপার ব্যবহূত হতো। এভাবেই নারায়ণ রায়ের স্নেহমাখা, সৃজনশীল ও স্বতঃস্কুর্ত পরিবেশে ১৯৪০ সালে শেষ হয় বাগানের কাজ। গ্রিক উর্বরতার দেবীর নামে বাগানের নাম রাখলেন ‘সিবিলি’। জমিদার পরিতৃপ্তির আনন্দে বিভোর। কিন্তু এই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না, আততায়ীদের হাতে নিজের একমাত্র পুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণ রায় খুন হলে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েন। তিন বছরের ব্যবধানে ’৪৩ সালের ১৩ আগস্ট তিনিও মারা যান। সিবিলিতে পুত্রের পাশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
বলধা গার্ডেন নারায়ণ রায়ের দেওয়া নাম নয়। সাইকি ও সিবিলিকে জোড়া দিয়ে সবাই তাঁর জমিদারির নামানুসারে বলধা গার্ডেন বলা শুরু করেন। বাগানের সর্বমোট আয়তন দশমিক এক হেক্টর হলেও সাইকি অংশ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যথাক্রমে ১০০ ও ৪৫ মিটার। সিবিলি অংশ সর্বসাধারণের জন্য উন্নুক্ত হলেও সাইকি সংরক্ষিত। ধারণা করা হয় যে নারায়ণ রায় সাইকি অংশ দিয়েই বাগানে প্রবেশ করতেন। বাসস্থান বলধা হাউস ও সাইকি আলাদা করেছিলেন অনুপম গ্রিন হাউস বা ছায়াবীথি তৈরি করে। সেই গ্রিন হাউসের ভেতর তিনি মাটি ও পাথর দিয়ে বানিয়েছিলেন কৃত্রিম পাহাড় ও সুড়ঙ্গ।

বাগানের ক্রান্তিকাল
জমিদারের মৃত্যুর পরপরই স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে বলধার প্রাণপ্রদীপ। শুধু অর্থানুকুল্য নয়, তাঁর স্নেহমাখা পরিচর্যা থেকেও বঞ্চিত হয় বাগানের গাছপালা। নানা অসুবিধা সত্ত্বেও বাগানকর্মীরা হাল ছাড়েন না। কেবল প্রাণে বেঁচে থাকে অসংখ্য গাছপালা, আর এর প্রায় পুরো কৃতিত্বই অমৃতলাল আচার্যের। ’৪৭ সালে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হলেও নিভৃতেই থেকে যায় বলধা গার্ডেন। ’৫১ সালে বলধা বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয় কোর্ট অব ওয়ার্ডের ওপর। এ সময় অমৃতবাবু ও তাঁর সহকর্মীরা খেয়ে না খেয়ে, বিনা বেতনে, অর্ধবেতনে কোনো মতো প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেন বাগানকে। তবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়ে প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে বাগান। ’৬২ সালের দিকে বলধা গার্ডেন বন বিভাগের অধীনে ন্যস্ত হলে সাময়িকভাবে অবস্থার পরিবর্তন হয়, এ সময় অমৃতবাবুকে বন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিছুদিনের মধ্যেই আবার সরকারি নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায় বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ। স্বাধীনতার পর কিছুদিন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হিসেবে বলধা বাগানের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুবউদ্দীন চৌধুরী। আন্তরিকভাবেই তিনি বাগানের উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করেন। বাংলার বিচিত্র প্রকৃতি গ্রন্েথ তিনি জানিয়েছেন, ‘খরার মৌসুমে শঙ্খনদ পুকুরকে পানি দিয়ে ভরিয়ে রাখা ও বাগানের গাছপালার জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করাই হয়ে উঠল আমাদের প্রথম ও প্রধান উন্নয়ন প্রচেষ্টা। টাকার প্রয়োজন। বন বিভাগের বাজেট থেকে যে টাকা পাওয়া যায়, সেটা অপ্রতুল।’ অবশেষে তিনি কিছু অর্থ সংগ্রহে সমর্থ হন এবং তা দিয়েই বাগান সংস্কারের কাজ শুরু করেন।

কিছু প্রস্তাব
বলধা গার্ডেন আজ বিপন্ন। এ বাগানের শুধু উত্তর পাশটা উন্নুক্ত, বাকি তিন পাশ ঘিরে রেখেছে সুউচ্চ দালানকোঠা। ফলে সারা বছরই রোদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার দুর্লভ উদ্ভিদ প্রজাতি। প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসের অভাবে ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে কয়েক প্রজাতির গাছ। হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও অনেক প্রজাতি। অতিরিক্ত ছায়ায় বিবর্ণ হয়ে পড়েছে সাইকির দক্ষিণাংশের গাছপালা। উঁচু ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র করে পরিবেশবাদীরা ব্যাপক লেখালেখি ও আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা এই বাগানকে আরও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন দুঃসময়েও হারিয়ে গেছে কিছু সংগ্রহ। জমিদারের অকাল মৃত্যুতে কিছু সংগ্রহের সঠিক উপাত্তও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব হারিয়ে যেতে পারে বলেও কেউ কেউ ধারণা করেন। ইদানীং কিছু কিছু গাছ শনাক্তের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া বাগানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কখনোই পর্যাপ্ত বাজেট থাকে না। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও বন্ধ থাকে। জমিদারের আমলে যেখানে মালির সংখ্যা ছিল ৪০, বর্তমানে তা কমে দাঁড়িছে পাঁচজনে।
অনেক নিসর্গীই মনে করেন, অন্যত্র এর আদলে হুবহু আরেকটি বাগান তৈরি করে সেখানে একই পদ্ধতিতে গাছপালা রোপণ করা দরকার। এর জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে ঢাকার অদুরে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান বা সংলগ্ন এলাকা। বলধা বাগানের সমপরিমাণ জায়গা নিয়ে বিদ্যমান নকশায় গ্রিড ধরে ধরে সেই বাগানের প্রতিটি উদ্ভিদের চারা একটি করে রোপণ করে সৃষ্টি করা যায় নতুন বলধা গার্ডেন। এর জন্য আগে থেকেই বানাতে হবে বিশেষ বীজতলা। বীজ আসবে বাগান থেকে। ইতিমধ্যে যেসব গাছ হারিয়ে গেছে তা আবার সংগ্রহ করতে হবে, যেসব গাছ বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সেসবও। আর এসব কাজে আমাদের পাশে থাকতে পারে ইউনেস্কো। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোনোভাবেই যেন উদ্যানের পুরোনো নকশার বিকৃতি না ঘটে, অবহেলার শিকার না হয় আদি উদ্যান।

1 comment:

  1. very nice sushan bormon.

    carry this type of activity for our country and our environment and for yourshalf.

    best regards/syed
    for : http://www.facebook.com/n/?group.php&gid=30368849578

    ReplyDelete