Friday, May 30, 2008

বলধার ছিন্ন স্মৃতি

বলধা গার্ডেনের শত বৎসর পূর্তি উপলক্ষে আজকের সমকাল পত্রিকার কালের খেয়া সংখ্যায় বরেণ্য প্রকৃতিপ্রেমিক দ্বিজেন শর্মার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লেখাটি এখানে পুন:প্রকাশ করছি।

দ্বিজেন শর্মা

বলধাবাগানের সঙ্গে হার্দ সম্পর্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সেই ১৯৫৬ সাল থেকেই, যখন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সেখানে যাতায়াত ছিল বাধ্যতামূলক। কার্জন হল চত্বরের ক্ষুদে বোটানিক উদ্যান ছাড়া তখন ঢাকায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ সংগ্রহ ছিল শুধু বলধায়। সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক অমৃতলাল আচার্যের সঙ্গে পরিচয়, যা পরে নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। বলধাবাগানের তখন দারুণ দুর্দিন, জমিদারি উচ্ছেদের পর অভিভাবকহীন। মালীরা বেতন না পেয়ে উধাও, অমৃতবাবু হয়েছেন তাদের বদলি; কিন্তু ১৫-২০ জনের কাজ তার সাধ্যাতীত। তাই মারা পড়ে অনেক মূল্যবান দুর্লভ বিদেশি প্রজাতি। সরকার বাগানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে চেয়েছিল রক্ষণাবেক্ষণের কোনো মঞ্জুরি ছাড়া। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এ দায়ভার গ্রহণ সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত বন বিভাগের ওপর এটির দায়িত্ব বর্তালে সরকারি চাকরির আশায় মালীরা কাজে ফেরেন এবং বাগানটিও রক্ষা পায়; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি না থাকায় অমৃতবাবুর চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। শেষে তার বন্ধু অধ্যাপক মুয়ায্যম হুসাইন খান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে তাকে স্বপদে বহাল রাখার ব্যবস্থা করেন। তাতে বাগানটিও উপকৃত হয়। কেননা এ পদে তার স্থলবর্তী হওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি সেকালেও ছিলেন না, একালেও দুর্লভ।
অমৃতবাবুকে এড়িয়ে বলধাবাগানের বিবরণ পূর্ণ হওয়ার নয়। তার পিতা শ্যামলাল আচার্য ছিলেন শ্যামলী রমনার স্থপতি প্রাউডলক ও অখিল চন্দ্র চক্রবর্তীর কর্মী দলের সদস্য। জন্মনিসর্গী অমৃতলাল নজরে পড়েন বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর। তিনিই তাকে প্রশিক্ষিত করেন এবং বাগান দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। কোনো অবস্থাতেই বাগান ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করেন আর অমৃতবাবু তা মান্য করেছেন ক্যাসাব্লাঙ্কিয় নিষ্ঠায়। পাকিস্তানি আমলের একাধিক মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালেও বাগানেই থেকে গেছেন তিনি। চিরদিন স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন। তাই বাগানটি সরকারিকরণের পরবর্তী পরিস্থিতিতে বড় বেশি সন্ত্রস্ত থাকতেন, ভয় পেতেন আমলাদের। ১৯৭৪ সালে মস্কো যাওয়ার আগে আমার উদ্যোগে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ একটি উদ্যান সংখ্যা প্রকাশ করে। তাতে অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর অমৃতবাবু একটি প্রবন্ধ লিখতে রাজি হন; তবে ছদ্মনামের শর্তে। বাগানের প্রথম সরকারি পরিচালিকা পারভিন এ হাশেম সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন না তিনি। অবশ্য আশঙ্কাটি অমূলক প্রমাণিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা গুরু-শিষ্য পর্যায়ে পৌঁছে। পারভিনের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে, টেলিফোন আলাপ আরো বেশি। বিটিভির জন্য তার একটি সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম ‘সাইকি’র কনকসুধা কুঞ্জে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লতাটির বৈজ্ঞানিক নাম Odontaderia grandiflora (o. speciosa), গোত্র Apocynaceae, ক্রান্তীয় দক্ষিণ আমেরিকা ও ওয়েষ্ট ইন্ডিজের প্রজাতি। এটি আমদানির সময় হারিয়ে যায়। অক্লান্ত চেষ্টার পর নরেন্দ্রবাবু তা উদ্ধার করেন অষ্ট্রেলিয়ার এক বন্দর থেকে। অমৃতবাবুর এই প্রিয় লতাটির বাংলা নামকরণ করেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের আমার প্রিয় ছাত্র এবং অমৃতবাবুর শেষ জীবনের বন্ধু অধ্যাপক সানাউল্লাহ। একবার মস্কো থেকে ফিরে বলধাবাগানে গেলে পারভিন আমাকে শঙ্খনদ পুকুরে নতুন লাগানো ভিক্টোরিয়া অ্যামাজনিকা ও নানা রঙের শাপলা দেখাতে নিয়ে যান। সেখানে আমাদের জাতীয় ফুল সাদা শাপলা না দেখে কারণটি জানতে চাইলে পারভিন অবাক হন। তিনি বলেন, অনেকটিই ছিল। আমি জানতাম তেলাপিয়া মাছ লাল শাপলা বা রক্তকুমুদ ছাড়া অন্য শাপলার যম। তথ্যটি দিয়েছিলেন মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও আরেক প্রকৃতিপ্রেমী ডা. বিষষ্ণুপদ পতি। পারভিনকে সে কথা জানাই। তিনি পুকুর সেচে তেলাপিয়া তাড়িয়ে আবারো শাপলা লাগান। এতটাই উদ্যোগী ছিলেন এই প্রকৃতিপ্রেমী নারী। পরেরবার মস্কো থেকে ফিরে বাগান নিয়ে পারভিনের খোঁজ করলে শুনি তিনি বেঁচে নেই। বড় অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে গেলেন। বড় একটা ক্ষতি হলো বলধাবাগানের এবং সব উদ্যানী ও প্রকৃতিপ্রেমীর। বরিশালের নিসর্গী চক্ষু চিকিৎসক ডা. এম আহমেদ ছিলেন বলধাবাগান ও অমৃতবাবুর এক অকৃত্রিম একনিষ্ঠ বান্ধব। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও বলধাবাগানে আসতেন, অমৃতবাবুর সঙ্গে গল্প করতেন। এম আহমেদ আমাদের দেশে অনেক দিন পর পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে ভিক্টোরিয়া অ্যামাজনিকা (আমাজন লিলি) চাষে সফল হন এবং বলধাকে কয়েকটি চারা উপহার দেন। বলধার নীল-বেগুনি সুগন্ধি শালুক (Nymphaea capenbis) প্রজাতিটিও তারই দেওয়া। অমৃতবাবুর একটি স্বপ্ন ছিল, ডা. এম আহমেদের সঙ্গে আমাজন লিলির পাশে দাঁড়িয়ে একটি ফটো তোলা, যা আর পূরণ হয়নি। দু’জনেই প্রয়াত হন খুব কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে- যথাক্রমে ১৯৮২ সালের ২২ ডিসেম্বর ও ১৯৮৩ সালের ৪ জানুয়ারি।
ভারত উপমহাদেশে পার্ক বা বৃহদায়তন উদ্যান নির্মাণের কৃতিত্ব মোগলদের। এ শিল্পরীতির আদিরূপের একটি বিশিষ্ট আর্কিটাইপ এ মোগল উদ্যান, যা রীতিবদ্ধ, জলাধারযুক্ত এবং ছায়া ও শীতলতা সম্পৃক্ত। এটিই ভারতের একমাত্র নিজস্ব উদ্যানশৈলী, যা পরে ইংরেজ আগমনে আর বিকশিত হয়নি। বঙ্গভূমিতে ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের উদ্যানগুলো ছিল শাসক দেশের উদ্যানশৈলীর ব্যর্থ অনুকৃতি। সম্ভবত একক ব্যতিত্রক্রম এ বলধাবাগান, যা পুরাকীর্তির মর্যাদার দাবিদার। সে জন্য নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী পূজ্যপাদ। সাইকি শতবর্ষী, রীতিমুক্ত, অল্প জায়গায় অধিকসংখ্যক লতাগুল্ম প্রজাতির সুদৃশ্য বিন্যাসের এক দুর্লভ নজির। সত্তর বছরে সিবলী রীতিবদ্ধ, মাঝখানে চৌকো পুকুর, বৃক্ষপ্রধান। দুটি উদ্যানশৈলীই নির্মাতার উদ্ভাবন। অবশ্যই মৌলিক; যদিও এই অর্থে উপেক্ষিত যে, পরবর্তীকালের উদ্যানে এগুলোর কোনটিরই গড়ন আর অনুসৃত হয়নি। আমি যৌবনকাল থেকেই এ উদ্যান দুটি দেখে আসছি। তাই আমার চোখে এগুলোর ক্ষয় ধরা পড়ে। একালের বৈজ্ঞানিক প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আমাদের অনিচ্ছাকৃত অবহেলা- সবই এই অবক্ষয়ের হেতু হতে পারে। আমার জানা মতে, সাইকির দুটি মূল্যবান বৃক্ষ বাওবাব ও নাগকেশর (Ochrocarpus longifolius) আর নেই। শিবলীর কনকচাঁপা (Ochna squasrosa) গাছটিও ইদানীং মারা গেছে। এক সময় এখানে প্রচুর নীল, সাদা ও কাঁটা মিন্টি দেখেছি। এখন দেখি না। এবার তালগোত্রের দুর্লভ প্রজাতি Corypha elata গাছে ফুল ফুটেছে, যা তার মৃত্যুঘণ্টার আলামত। বলধাবাগান আমাদের জাতীয় বোটানিক উদ্যানের বেস গার্ডেন; অথচ গাছগুলোর নাম ও বানানের ভুলের পীড়াদায়ক ছড়াছড়ি। এ বাগান ঘিরে এখন বহুতল ভবন উঠছে। তাতে এলাকায় একটি মাইক্রোক্লাইমেট সৃষ্টি হতে পারে, যা হবে গাছগাছালির জন্য ক্ষতিকর। সিবলীতে ইদানীং কিছু দৃষ্টিকটু লিলি ফুল তৈরি হয়েছে। আমরা উদ্যান ও পার্কে ইটের কাঠামো নির্মাণকালে পরিবেশের সঙ্গে সেগুলোর মিলঝিলের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিই না, যা বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। এসব সত্ত্বেও আমাদের নতুন প্রজন্ম আজ অনেক বেশি পরিবেশ সচেতন। তারা এ অমূল্য ঐতিহ্যটি রক্ষা করবেন, বলধাবাগানের সমৃদ্ধি ঘটাবেন- এটিই প্রত্যাশা।

No comments:

Post a Comment